দেশের কিছু ব্যক্তি, মহল ও কয়েকটি গণমাধ্যম বছর কয়েক ধরে অবিরাম তারেক রহমানের পিণ্ডি উদ্ধার করেছে। চরিত্র হনন করেছে কারণে-অকারণে-অপ্রসঙ্গেও। একজন ব্যক্তিকে কত কলঙ্কিত ও ভুলভাবে চিত্রিত করা যায়, তার কোনো কমতি করা হয়নি। ডন-ভিলেন বানানোর চরম নিষ্ঠুরতার পর এখন বিপরীত চিত্র। প্রসঙ্গ ছাড়াও এখন তার স্তুতি-প্রশংসা-বন্দনা। তাকে নিয়ে গল্প-কবিতা-ফিচার-ছড়া। কলাম-পোস্টের বন্যা। বিএনপি বা তারেক রহমান কাউকে বলেছেন, এমনটি করতে? এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।
তারপরও যে-যেদিক দিয়ে পারছেন করেই যাচ্ছেন। অজু করে তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ করতে হবে—এমন কথাও মুখে আটকায়নি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো খেই হারানোর মতো বলেই ফেলেছেন, তারেক রহমান এ দেশের প্রথম শিশু মুক্তিযোদ্ধা। এই রেসে পড়ে কেউ কেউ তারেক রহমানকে ম্যান্ডেলাও বানিয়ে ফেলেন। বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কেউ কেউ তাকে তার মা বেগম খালেদা জিয়া বা বাবা জিয়াউর রহমানের চেয়েও যোগ্যতার আসনে নিয়ে নেন। নমুনাই বলে দিচ্ছিল, এটি আসমানে তুলে জমিনে আছাড় দেওয়ার রিহার্সাল বা মহড়া। সময়ের ব্যবধানে তা এখন কিছুটা বর্তমান। উচ্চারণ অসম্ভব জঘন্য-নোংরা কথার ঢোলে বাড়ির আলামতে তা স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানের যে কারোই বোধগম্য।
রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চার সভ্য দেশ ব্রিটেনে দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে তার ক্রমেই ম্যাচিউরড-প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠা মোটেই সবার জন্য ভালো খবর নয়। অনেকের কাছে তা হিংসার-যন্ত্রণার। তারেক রহমানের মা খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের জন্য যে সংগ্রাম, বাবা জিয়াউর রহমানের দেশের স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয় ভূমিকাও যেমন অসহ্য রাজনীতির প্রতিপক্ষের কাছে। আর বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে একটা ছেদ ফেলা, ধাক্কা দেওয়া; বিশেষ করে তারেক রহমানের ক্রমেই ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছতে থাকার মাঝে মুগুর মারা জরুরি মনে করেছে প্রতিপক্ষ। দ্রুত তারা সেখানে মুগুরের বাড়িটা মেরেছে।
মিটফোর্ড এলাকার নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘিরে বিএনপি এবং তারেক রহমানকে ক্রুসেড ফায়ারের সুযোগটা তারা নিয়েছে। দক্ষিণপন্থি কিছু দল ও জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের দল এনসিপিই নয়, বিএনপির একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামীও সমালোচনার মাঠে শামিল হয়েছে। নোংরা-কদাকার, উচ্চারণ অযোগ্য, লেখার অনুপযুক্ত শব্দ-বাক্য, স্লোগানে দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা। দ্রুততম সময়ে বিএনপির মতো বিশাল একটি দলকে কোণঠাসা করার কাজে সামান্যতম ছাড় দেয়নি তারা। তারেক রহমানকে করেনি ন্যূনতম মায়া-দয়াও।
চাঁদাবাজি, খুন, দখলের মতো কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ অব্যাহত ছিল। এরই মধ্যে সামনে চলে আসে মিটফোর্ড এলাকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। জুতসই ইস্যু। যদিও জামায়াতে ইসলামী বলেছে, এ ধরনের তৎপরতা তাদের দলের কেউ করছে না। আর এনসিপি বলছে, ‘তারেক রহমান যেহেতু বিএনপির একক নেতা, সে কারণে দলের কর্মীদের কর্মকাণ্ডের দায় তাকেই নিতে হবে।’ বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোকে মুখোমুখি করার একটি চেষ্টা অন্য কোনো মহল থেকে থাকতে পারে—এমন কানাঘুষাও আছে। যেখান থেকে যার ইশারা-ইঙ্গিতই থাক, মাঝ দিয়ে তারেক রহমানকে ঘায়েলের মহড়াটা হয়ে গেল। আসমান থেকে জমিনে নামানোর চেষ্টাও চলমান।
গত কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধমূলক ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম জড়ানোর পর বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শোনা যাচ্ছিল। যদিও দলটির নেতারা অনেক ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তারপরও দলটি কেন তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে এসেছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়বে। পরস্পরকে ঘায়েলের চেষ্টা চলবে। যে যাকে পারবে কোণঠাসা করবে। গুজব রটাবে। দরে মিললে কাছে টানবে, জোট করবে। গালাগালি বাদ দিয়ে গলাগলি করবে। নইলে বদনাম রটবে, রটাবে—এসবে দেশের মানুষ অভ্যস্ত। তাই বলে এ মানে, এ পর্যায়ে? ১৭ বছরের শারীরিক-মানসিক জুলুমের শিকার ব্যক্তির জন্য সামান্যতম মায়ার রেখাপাতও থাকতে নেই?
একজন রাজনীতিকের সত্যিকারের জনপ্রিয়তা পরিমাপ করা হয় ক্ষমতার বাইরে থাকতে। ক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম ও দলীয় কর্মীরা নেতা-নেত্রীর বন্দনায় মগ্ন থাকেন। আবার তারাও কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে ‘বাধ্যতামূলক’ সমীহ আদায় করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। তিনি ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে এবং ৬ বছর প্রায় বন্দিজীবন যাপন করার পরও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। এমন বহু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা বিএনপির রাজনীতি করেন না, বিএনপির নীতি-আদর্শেরও সমর্থক নন, তারাও রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়াকে পছন্দ করেন। ব্যক্তিগত সৌজন্যবোধ, মৃদুভাষিতাসহ আরও নানা গুণে এটি তার অর্জন। অর্জনের ঝুড়ি ভরপুর তারেক রহমানেরও।
২০১৮ সাল থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলকে সংগঠিত করছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন। তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলে প্রশংসিত। বিদেশি গণমাধ্যমেও নানা বিশ্লেষণ। ব্রিটিশ সাপ্তাহিকী দ্য উইক তারেক রহমানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছে। শিরোনাম ‘ডেসটিনিস চাইল্ড’ বা নিয়তির সন্তান। সেখানে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার যখন বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করেছিল, তখন তিনিই দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। নিয়তির সন্তান তাকেই বলা হয়, যিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে লক্ষ্যে পৌঁছে যান। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে দ্য উইক বলেছে, ‘তারেক বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে রয়েছেন। কারণ, তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।’
এরকম একটা অবস্থায় তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন—এ অপেক্ষা। কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে বলছে, তারেক জিয়া বীরের বেশে, আসবে দেশে! এর মাঝেই নোংরা আক্রমণের আকস্মিক বৃষ্টিপাত। সেইসঙ্গে ব্লেম গেম। নির্বাচনের আগেই ঘায়েল করার নন-স্টপ সাইবার ক্রুশ। গত দেড় যুগে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আচরণের যে পাঠ নিয়েছেন, তা তার সাম্প্রতিক কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়েছে। এর সুবাদে তিনি দলকে যতখানি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিছুদিনে তার চেয়ে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে তার দলের কিছু লোক। তাদের লাগামহীন, অভব্য ও অদূরদর্শী কথাবার্তা এবং চাঁদাবাজি-তোলাবাজি মানুষকে চরমভাবে বিরক্ত করে তুলেছে। সেইসঙ্গে তারেক বন্দনায় মাতোয়ারা আরেক গ্রুপ। জামায়াত-এনসিপিসহ অন্যরা ষোলোআনা এ সুযোগটি নিয়েছে। শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে নিয়ে যেটা করার কেউ সাহস পায়নি, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার রেশ ধরে তার চেয়েও বেশি করা হচ্ছে।
গত বছর ৫ আগস্টের পর তারেক রহমানের দায়িত্বশীল বক্তব্য-আচরণের পর বিএনপি যতটুকু অর্জন করেছে, মিটফোর্ডসহ কয়েকটি ঘটনা, তার চেয়ে কম কেড়ে নেয়নি। একের পর এক ঘটনার পরম্পরা এবং এক সময়ের এ সহযাত্রীরা ঘামজ্বর দিয়ে ভুগিয়ে ছাড়ছে বিএনপিকে। তারা ৩১ দফা বোঝে, বিএনপি যে দেশের সব চেয়ে বড় দল, তাও জানে। টানা ১৫-১৬ বছর বেদম নিপীড়ন সয়েছে, সেই ব্যথা এখনো কাঁদায়, কিন্তু তাদের দানবীয় হয়ে ওঠা যে দলকে দিন দিন রসাতলে নিচ্ছে, তা বোঝে না। বহিষ্কারসহ নিয়মিত নানা শাস্তিতেও তারা দমছে না। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠী সুবিধা তাদের অন্ধ করে দিচ্ছে। এ সুযোগটাই নিচ্ছে একসময়ের সহমত পার্টিরা। অপরাধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দল হিসেবে বিএনপির কী করার আছে? তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় নেই। দলের পক্ষে একজন কর্মীকে সর্বোচ্চ বহিষ্কার পর্যন্তই তার ক্ষমতা। জামায়াত বা এনসিপির অনেক কর্মীর বিরুদ্ধে বহু ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠার পর তাদের জেল হয়নি, কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিছু বহিষ্কার হয়েছে। কারণ গ্রেপ্তার বা জেল দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে শুধু সরকারের। বিএনপির ফৌজদারি অপরাধ করা কর্মীদের সরকার কেন বিচারের মুখোমুখি করে না, গ্রেপ্তার করে না? এ প্রশ্নটি কিন্তু জোরেশোরে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে বিশেষ কেউ কি চায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা এসব নিয়েই থাকুক? দলটি পচুক? তারেক রহমানের বদনাম হতে থাকুক? তার এতদিনের অর্জন ধুলায় মিশুক?
দেশে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করতে সুনির্দিষ্ট চক্রান্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘এখন যে অপপ্রচার চলছে, তার পেছনে একেবারে সুনির্দিষ্ট চক্রান্ত রয়েছে। সেই চক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া। সেই চক্রান্ত হচ্ছে যে নেতা (তারেক রহমান), যিনি উঠে আসছেন, যার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাকে নিশ্চিহ্ন করা। তাকে খারাপ জায়গায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা।’ গণমাধ্যমের চিত্র পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল দলের নেতাকর্মীদের ‘সাইবার যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। তার একটি উপলব্ধির কথাও জানিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘এখন কিন্তু মিডিয়া পাল্টে যাচ্ছে। এখন খবরের কাগজ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এটাই শুধু প্রভাবিত করছে না। সোশ্যাল মিডিয়া (সামাজিকমাধ্যম) প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করছে মানুষকে।’ তাই অপপ্রচারের জবাব দিতে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান তার। অবস্থা কোথায় গেলে এমন আহ্বান তথা প্রতিক্রিয়া, কে না বোঝে? আরও বেশি বোঝে প্রতিদ্বন্দ্বীরা। টোকায় যে কাজ হচ্ছে, তা ভালোভাবে অনুমান করতে পারছে তারা। তাই টোকার গতি বাড়ছে আরও নানা দিক থেকে। মেঠো বাংলায় যাকে বলে ‘পেয়ে বসা’। মাথায় তুলে আছাড় মারা। দরকারে মাথায় তোলা। পরে পায়ে ডলা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন