দেশের ১৮ কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে অকালে ঝরে গেল ৩১টি তাজা প্রাণ। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আরও কিছু কচি মুখ। মাত্র কদিন আগে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলিয়ে হত্যা আর মৃতদেহের ওপর উন্মাদের মতো নৃত্য কাঁদিয়েছিল আমাদের। আজ আবার কাঁদলাম। জানি না এই কান্নার শেষ কোথায়?
দেশের সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। প্রশিক্ষণ বিমানের অবস্থান এবং বিমান চালনা প্রশিক্ষণের স্থাপনা ঢাকার মতো জনবহুল রাজধানীতে রাখার যৌক্তিকতা আজ ভেবে দেখা দরকার। তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর যখন গড়ে ওঠে, তখন কুর্মিটোলা ছিল লাল মাটিতে জন্মানো বন-জঙ্গলে ঠাসা দুর্গম এলাকা। ঢাকার নবাব ও বনেদি বংশের লোকজন এসব বন-জঙ্গলে পশুপাখি শিকার করতেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আর ঢাকা সেনানিবাস কুর্মিটোলা ও বর্তমান বিমানবন্দরের উত্তরার পশ্চিমাংশ ছিল বিল এলাকা। তখন বিমান প্রশিক্ষণের জন্য এসব এলাকায় উড্ডয়ন বা ঢাকায় ফ্লাইং ক্লাব প্রতিষ্ঠার পেছনে হয়তো যুক্তি ছিল। কিন্তু সেই বাস্তবতা এখন আর নেই। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিম দিক বাদ দিলে চারদিকেই ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। এমন বাস্তবতায় ঢাকার আকাশে সামরিক বা বেসামরিক বিমান প্রশিক্ষণের সুযোগ রাখার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বেশ কিছু বিমান ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল। ফেনী, কুমিল্লা, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, শমসেরনগরসহ আরও কিছু এলাকায় গড়ে ওঠা এমন বিমান ঘাঁটিগুলোর রানওয়ে আজও দৃশ্যমান। সংস্কার করে এসব রানওয়ে ঘিরে বিমান ও হেলিকপ্টার চালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমানের ফ্লাইং রুট নির্ধারণ করা যায়। দেশে অব্যবহৃত চরের সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এমনই একটি চরকে সুবর্ণচর নামকরণ করে এবং সেখানে বিভিন্ন পাল্লার ভারী অস্ত্রের ফায়ারিং এবং সেনাবাহিনীর যান্ত্রিক বহন নিয়ে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণসহ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বিমানবাহিনী ভবিষ্যতে এমন চরকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে, যার আশপাশে জনবসতির ছিটেফোঁটাও নেই।
আরবান বা শহুরে এলাকার ওপর দিয়ে উড্ডয়ন বিমান চালনা প্রশিক্ষণের একটি অংশ বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীতেও ফাইটিং ইন বিল্ট-আপ এরিয়া বা বসতি এলাকায় যুদ্ধ শীর্ষক প্রশিক্ষণ হয়। এসব প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে মডেল বা ডামি টাউন নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশে অব্যবহৃত চর এলাকায় বা একাধিক চর নিয়ে গড়ে তোলা যায় এমন কৃত্রিম শহর এলাকা, যেখানে চলবে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ।
বিগত সরকারের সময় অন্যান্য সেক্টরের মতো বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে মর্মে তথ্য প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। বেশ কজন উচ্চপদস্থ বিমানবাহিনী কর্মকর্তা বিশেষত বিগত দিনের বিমানবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া চলছে, যা দুঃখজনক। এ সময় বহুসংখ্যক সুরম্য অট্টালিকা, ব্যয়বহুল সীমানা প্রাচীর, চোখ-ধাঁধানো প্রবেশ গেট, বাগান, ফোয়ারা প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোনো প্রাচীর ভেঙে নতুন ডিজাইনের চমক লাগানো প্রাচীর নামের রাজকীয় সোনালি রঙের নকশা তৈরি ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব করতে গিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় আধুনিক প্রশিক্ষণ বিমান ক্রয় নিয়ে ছিল যত অনীহা। ফলে অতি পুরাতন মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান নিয়েই চলছে বিমান চালনা প্রশিক্ষণ। ত্রুটিপূর্ণ প্রশিক্ষণ বিমানকে বলা হয় ফ্লাইং কফিন। বাংলাদেশ এমন ফ্লাইং কফিন উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।
ঢাকা বিমানবন্দরের অতি কাছে কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং কেন বিমানবন্দরের এত কাছে তা গড়ে উঠেছে, সেই কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিমান ওঠানামার সময় শব্দ হলে তা শিক্ষার্থীদের মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায়। এ-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা কি নেই? যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার প্রবণতা আর একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে সনদ-সর্বস্ব বেকার তৈরির অবসান ঘটানো আশু প্রয়োজন।
এ দুর্ঘটনার সময় রাজনৈতিক নেতাদের পরিদর্শন ছিল দৃষ্টিকটু। তাদের একেকজনের সঙ্গে ছিল প্রটোকল ও সমর্থকদের বিশাল বহর, যারা উদ্ধারকাজে কোনো সহায়তাই করতে পারেনি। পক্ষান্তরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলসহ সর্বস্তরের মানুষ নিজ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তাও আশা জাগানিয়া। এর মধ্যে আবার দৃষ্টিকটু ছিল উদ্ধারকাজে সহায়তার বদলে ছবি ও ভিডিও ধারণের উন্মাদনা। হাসপাতালে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত সংকট ছিল দুঃখজনক। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় দুই কোটি রাজধানীবাসী থাকা সত্ত্বেও নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের রিজার্ভ না থাকা ভবিষ্যতের জন্য বিপদের ইঙ্গিত বহন করে। সবশেষে সব বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং আহতদের সুস্থতা কামনা করি। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরাপদ বাংলাদেশ করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই এখন সময়ের দাবি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন