

একই তারিখে হাই ভলিউমের দুই বাজনা। একদিকে নির্বাচনের তপশিল। আরেকদিকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের অভিপ্রায়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই দিনে হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট হবে সাদা আর গণভোটের গোলাপিতে। সেখানে লাল বা কালো কাণ্ড নেই। সাদা-গোলাপির সঙ্গে যোগ হয়েছে বৃহস্পতির ছাপ। এক বৃহস্পতি ১২ ডিসেম্বরে ঘোষণা হলো তপশিল। বাজল নির্বাচনের বাঁশি। গণভোট ও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট হবে আরেক বৃহস্পতিবার ১২ ফেব্রুয়ারিতে। তপশিল ঘোষণার দিনই বাজল রাষ্ট্রপতির কষ্টের হুইসেলও। বার্তা দিয়েছেন অভিমানের। জানিয়েছেন, পদত্যাগ করবেন তিনি। তবে, নির্বাচনের আগে নয়, পরে। দেশীয় নয়, তা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে। দেশীয় গণমাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের তপশিল ঘোষণা, জাতির উদ্দেশে ভাষণ আর বিদেশি গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের আগাম ঘোষণা। এ দুই ঘোষণা সাম্প্রতিক এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য বাড়তি বাজনা বাজিয়ে দিয়েছে।
এ দুই বাদ্য-বাজনা নির্বাচন ও গণভোটে কোনো ছেদ ফেলল কি? যে কোনো মানুষের জন্যই তা ভাবনা-আলোচনার খোরাক। আর সাংবাদিক তথা সংবাদকর্মীদের জন্য বাড়তি তথ্য জোগান। ভোট-ভোটারের খবর রাখা সাংবাদিকদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলে থেকেও ভোট দেওয়া যাবে। সরকারি চাকরিজীবীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা তো আছেই। সাংবাদিকরা তেমন কোনো বন্দোবস্তের বাইরে। এ কষ্ট-অতৃপ্ত আবহের মাঝেই তাদের কাজের চৌহদ্দি চলে গেল বঙ্গভবনের দিকে। গণভবন প্রায় দেড় বছর ধরে সংবাদ ক্ষেত্রের বাইরে। সেখানে এখন বঙ্গভবন যোগ মানে সংবাদকর্মীদের দায়িত্বের আওতা বৃদ্ধি।
তপশিল অনুযায়ী নির্বাচনে ইচ্ছুকদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে ৪ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত। মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আপিলের সময় ৬ থেকে ১২ জানুয়ারি। মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত। আপিল নিষ্পত্তি ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহার ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ হবে ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনী আনুষ্ঠানিক ক্যাম্পেইন শুরু হবে ২২ জানুয়ারি। চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ভোট দেওয়ার সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে যোগ হলো নতুন ঘটনা। আরও নতুনত্বে রয়েছে পোস্টাল ব্যালটে চার ক্যাটাগরির ভোটের ব্যবস্থা করা। আরপিও নীতিমালা অনুযায়ী রাজধানীতে কর্মরত কিন্তু অন্য এলাকার ভোটার এমন গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য পোস্টাল ভোটের সুযোগ আপাতত নেই। প্রবাসীরা ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ মোবাইল অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন/নিবন্ধন করে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীরা, পোলিং অফিসাররা এবং জেলে আটক বা আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের যখন কাজের ভলিউম ও দায়িত্ব বাড়বাড়ন্ত তখন আর নিজের ভোটের ভাবনার ফুরসতইবা কই!
এরপরও নানা প্রশ্ন, শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নির্বাচনের হুইসেল বেজেছে—এটি মোটা দাগের খবর। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ভোট আয়োজনে ইসির নানা চ্যালেঞ্জের কথাও। সব রাজনৈতিক দল, প্রার্থীদের ভোটে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ভোটারদেরও নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অভয় দিয়েছেন। ভাষণের আগে প্রথামতো তার নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছে গোটা নির্বাচন কমিশন। বাড়তি হিসেবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও দেখা করেছেন। বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও দেখা করার সাবলীল খবর প্রচার হয়েছে। এবার নতুনত্ব হিসেবে নির্বাচনের দিনেই গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ায়, ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা করা হয়েছে। নতুনত্ব আনা হয়েছে তপশিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণের দিনের তারতম্যেও। রেওয়াজ অনুযায়ী, তপশিল ঘোষণা থেকে ভোটগ্রহণের দিনের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ দিনের পার্থক্য থাকে। এবার সেই সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই মাস। এর আগে বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে নির্বাচনের তপশিল চূড়ান্ত করে নির্বাচন কমিশন। পরে জাতির উদ্দেশে সিইসির ভাষণ রেকর্ড করে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার। আগের দিন সাক্ষাতের সময় রাষ্ট্রপতির যাবতীয় সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সায় দিয়েছেন। দিয়েছেন সহায়তার আশ্বাস। আশাবাদ জানিয়েছেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের। তখন পর্যন্ত বা পরদিনও কোনো আভাস ছিল না যে এক দিন পরই যে তিনি পদত্যাগের আগাম ইচ্ছা পোষণ করবেন। এ-সংক্রান্ত ন্যূনতম গুঞ্জন-গুজবও ছিল না। সিইসির ভাষণ প্রকাশের কিছুক্ষণ পর ধরা দেয় নতুন খবর। তাও বিদেশি গণমাধ্যমের বরাতে। বঙ্গভবন থেকে রয়টার্সকে হোয়াটঅ্যাপ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন জানালেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বারা তিনি অপমানিত বোধ করছেন।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সাহাবুদ্দিন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তবে পদটি অনেকটাই আলংকারিক। দেশের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার হাতে থাকে। ২০২৪ সালের আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি পালিয়ে যেতে বাধ্য হলে রাষ্ট্রপতির পদের গুরুত্ব বাড়ে। কারণ, অভ্যুত্থানের পর সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে রাষ্ট্রপতিই একমাত্র সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বহাল থাকেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০২৩ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মো. সাহাবুদ্দিন। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় ১২ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না আওয়ামী লীগ। এতদিন কথাগুলো এলোমেলো বিক্ষিপ্ত আলোচনা হলেও এখন সেটা পাবলিক হয়ে গেল তার সাক্ষাৎকারে। সেখানে স্পষ্ট তাকে কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ এনেছেন। বলেছেন, ‘আমি সরে যেতে চাই। আমি চলে যেতে আগ্রহী।’ পরক্ষণে আবার এও বলেছেন, ‘নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমার দায়িত্ব পালন করে যাওয়া উচিত। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদে থাকায় আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’
সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রায় সাত মাস হয় অধ্যাপক ইউনূস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। তার জনসংযোগ বিভাগ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে তার ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। …‘সব কনস্যুলেট, দূতাবাস ও হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতি, রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল। হঠাৎ এক রাতেই সেগুলো উধাও করে ফেলা হয়েছে। এতে মানুষের কাছে একটি ভুল বার্তা গেছে যে সম্ভবত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি খুবই অপমানিত বোধ করেছিলাম।’ আরও জানিয়ে দিলেন, প্রতিকৃতি সরিয়ে ফেলার বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূসকে তিনি লিখিতভাবে বলেছেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক ইউনূসের প্রেস সচিবরা তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেননি। সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়—এ তথ্যও জানিয়েছেন। উঠে এসেছে আরও অনেক তথ্য। সাহাবুদ্দিন বলেন, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্ট করেছেন দেশের ক্ষমতা নেওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। বাংলাদেশে সামরিক শাসনের ইতিহাস রয়েছে। তবে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলে আসছেন, তিনি চান দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। আরও যোগ করেন, …যদিও কিছু ছাত্র বিক্ষোভকারী শুরুর দিকে তার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কোনো রাজনৈতিক দল তাকে পদত্যাগ করতে বলেনি। ২০ বছর দেশ শাসন করা শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে তিনি দলনিরপেক্ষ, কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।
রীতিমতো বিস্ফোরক যত তথ্য উঠে এসেছে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকারে। এটি যত না সাক্ষাৎকার, তার চেয়ে বেশি তথ্যে ঠাসা। মাত্রাগত তপশিলের সমান্তরাল গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, কমও নয়। নির্বাচনের তপশিলের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকারের নিউজ ভ্যালুও অনেক। আলোচনা-সমালোচনাসহ প্যারালালে গসিপ চলছে সমানে। তপশিল ঘোষণায় সিইসি বলেছেন, সামনের নির্বাচনটি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করবে। বিশ্ব দরবারে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকারে কার কোন প্রত্যাশা পূরণ হয়, গভীর পর্যবেক্ষণ ও অপেক্ষার বিষয়। সিইসি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের বিশেষ করে সাংবাদিকদের সংবাদক্ষেত্র ও পর্যবেক্ষণের আওতা যে আরও বেড়ে গেল! এ নীতিমালা দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল অংশীজন, অর্থাৎ, গণমাধ্যমসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা না করার অভিযোগ উঠেছে আরও আগেই। ভোটের সময় নানা জায়গায় দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিকরা ভোট দিলেই কি, না দিলেইবা কি—বিষয়টা এমন? খবরের মানুষরা তো খবরই খুঁজবে। গণভবন না হলে বঙ্গভবন। নইলে অন্য কোথাও।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন