

মানুষের জীবনে সম্পর্ক শুধু পাশাপাশি থাকা নয়, বরং পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা, শোনা ও অনুভব করার বিষয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মুখোমুখি কথোপকথন মানুষে মানুষে বোঝাপড়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা, কণ্ঠস্বরের ভেতর লুকিয়ে থাকা আবেগ, নীরবতার মধ্যকার অর্থ—এসব মিলিয়েই গড়ে উঠেছে পরিবার, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা। অথচ প্রযুক্তিনির্ভর এ সময়ে এসে সেই স্বাভাবিক কথোপকথনের জায়গাটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সেই শূন্যস্থান দখল করছে স্মার্টফোন। যোগাযোগের সুবিধা বাড়ানোর নামে এ যন্ত্রটি আজ আমাদের সম্পর্ককে এমনভাবে বন্দি করে ফেলেছে যে, আমরা কথা বলার মানুষ হয়েও ধীরে ধীরে নীরব হয়ে যাচ্ছি।
বর্তমান বাস্তবতায় একজন মানুষ দিনে গড়ে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছে স্মার্টফোনের পর্দার সামনে। কাজ, বিনোদন, খবর, সামাজিক যোগাযোগ সবকিছুই এক স্ক্রিনে বন্দি। কিন্তু এ সময়টা আসছে কোথা থেকে, সে প্রশ্ন খুব কমই তোলা হয়। আসছে পরিবারের সঙ্গে বসে গল্প করার সময় থেকে, বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের সময় থেকে, দিনের শেষে প্রিয়জনের পাশে চুপচাপ বসে থাকার সময় থেকে। ফলে সম্পর্কের ভেতরের কথোপকথন কমে যাচ্ছে, বাড়ছে নীরব সহাবস্থান। মানুষ একসঙ্গে থাকছে, কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে নয়।
পরিবারে এ পরিবর্তন সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এক টেবিলে বসে খাওয়া হলেও চোখ থাকে স্ক্রিনে, কানে থাকে হেডফোনে। বাবা-মা সন্তানের কথা শোনার বদলে ফোনে ব্যস্ত থাকেন, সন্তানরাও শিখে নেয় কথা বলা জরুরি নয়, পর্দাই যথেষ্ট। ফলে পরিবারের ভেতরের আবেগী যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। সমস্যা, ভয় কিংবা আনন্দ আর ভাগাভাগি হয় না, জমে থাকে ভেতরে। ধীরে ধীরে পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানটি কথার জায়গা হারিয়ে নীরবতার ঘরে পরিণত হয়।
দাম্পত্য সম্পর্কেও স্মার্টফোন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিচ্ছে। একসঙ্গে থাকা আর একসঙ্গে থাকা এক নয়—এ সত্যটি আজ সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় দাম্পত্য জীবনে। দিনের শেষে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে স্বাভাবিক কথোপকথন হওয়ার কথা, তা প্রায়ই আটকে যায় ফোনের পর্দায়। ছোট ভুল বোঝাবুঝি কথা বলে মিটে যাওয়ার বদলে জমতে থাকে, কারণ কথা বলার অভ্যাসটাই কমে গেছে। এই জমে থাকা নীরবতাই এক সময় সম্পর্কের গভীরে ফাটল ধরায়, যার শব্দ অনেক দেরিতে শোনা যায়।
তরুণ প্রজন্মের সম্পর্কেও মুখোমুখি কথোপকথনের সংকট ভিন্ন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। বন্ধুত্ব এখন আর আড্ডা, হাঁটাহাঁটি কিংবা দীর্ঘ আলাপে সীমাবদ্ধ নয়, সীমাবদ্ধ হয়েছে চ্যাট, স্টোরি আর রিলসে। অনলাইনে সক্রিয় থাকাই যেন সম্পর্কের প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তব উপস্থিতি ও সরাসরি কথোপকথনের অভাবে তরুণদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা, ধৈর্য ও সহানুভূতি কমে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ তারা ডিজিটালি সংযুক্ত থেকেও মানসিকভাবে একা হয়ে পড়ছে।
সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। শিশুরা বড় হচ্ছে এমন পরিবেশে, যেখানে বড়রাই কথা বলার বদলে স্ক্রিনে বেশি সময় কাটান। ফলে তারা শেখে না কীভাবে অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়, কীভাবে অন্যের কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। এ প্রজন্ম বড় হলে সমাজে সম্পর্ক গড়ে তোলার সক্ষমতাই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে, যা শুধু পারিবারিক নয়, বরং একটি সামগ্রিক সামাজিক সংকট।
এখানে প্রযুক্তিকে পুরোপুরি দোষারোপ করা সহজ, কিন্তু সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। স্মার্টফোন নিজে কোনো শত্রু নয়, শত্রু হয়ে উঠছে অযত্নশীল ব্যবহার ও অগ্রাধিকার। আমরা যোগাযোগের অসংখ্য মাধ্যম পেয়েছি, কিন্তু যোগাযোগের মানবিক অনুশীলন হারিয়ে ফেলছি। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথও মানবিক। পরিবারে সচেতনভাবে স্ক্রিনমুক্ত সময় রাখা, কারও সঙ্গে কথা বলার সময় ফোন পাশে না রাখা, বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি সময় কাটানোর চর্চা এসব ছোট সিদ্ধান্তই পারে সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরিয়ে আনতে। সম্পর্ক বাঁচাতে প্রযুক্তির গতি কমানো নয়, বরং মানুষের প্রতি মনোযোগ বাড়ানোই সবচেয়ে জরুরি।
শেষ পর্যন্ত মানুষ বাঁচে কথায়, উপস্থিতিতে আর বোঝাপড়ায়। স্মার্টফোন হাতের মুঠোয় থাকতেই পারে, কিন্তু সম্পর্ক যেন বন্দি না হয় তার পর্দার ভেতরে। মুখোমুখি কথোপকথন কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানবিক জীবনের অপরিহার্য শর্ত। এ কথোপকথন হারালে আমরা হয়তো সংযুক্ত থাকব, কিন্তু মানুষ হিসেবে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ব।
তহমিনা ইয়াসমিন, শিক্ষার্থী
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন