

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) যৌথভাবে প্রায়ই পাটশিল্প খাতের উন্নয়নের বিষয়ে করণীয় কিছু প্রস্তাব এবং কতিপয় সমস্যা দূরীকরণে সরকার তথা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করে থাকে। সভায় সরকারি কর্মকর্তারা মনোযোগ সহকারে প্রস্তাবগুলো শোনেন এবং তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন। তেমন একটি প্রস্তাব হলো—‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০’-এর শতভাগ বাস্তবায়ন, এ আইন ২০১০ সালে পাস হওয়ার পর ১৯টি পণ্যে যথা—ধান, চাল, গম, ভুট্টা, আলু, সার, চিনি, পোলট্রি ফিড, ফিশ ফিড, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল, ধনিয়া, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়া মোড়কীকরণে পাটজাত পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও আইনটি এখনো শতভাগ বাস্তবায়িত হয়নি। অ্যাসোসিয়েশন দুটির আরেকটি প্রস্তাব হলো—পাটজাত পণ্যকে ‘কৃষিপণ্য’ হিসেবে বিবেচনা করে কৃষিপণ্যের সব সুযোগ-সুবিধা পাটজাত পণ্যকে প্রদান করা। পাটজাত পণ্যকে কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হলে দেশের পাটকলগুলো কৃষিপণ্যের ন্যায় কিছু কর সুবিধা পেত বা ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে কিছু রিবেট পাওয়া যেত বা পাটশিল্পের জন্য আমদানিকৃত মেশিনারিতে কিছুটা কর, ভ্যাট সুবিধা পাওয়া যেত বলে অ্যাসোসিয়েশন দুটি মনে করে। কৃষি মন্ত্রণালয় ‘কৃষি বিপণন আইন ২০১৮’-এর তপশিল-১-এর ‘ঠ’ ক্রমিকে পাটজাত পণ্যকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এখনো পাটজাত পণ্য কৃষিজাত পণ্যের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা পায়নি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাটজাত পণ্যের বিকল্প পণ্যের ব্যবহার দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যেমন—সুদান, ইরাক, ইরানের ওপর আমেরিকার অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ থাকায় পাটজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার ক্রমেই সংকীর্ণ হতে থাকে। অ্যাসোসিয়েশন দুটি মনে করে, যদি পাটজাত পণ্যকে কৃষিপণ্যের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হতো এবং ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ শতভাগ বাস্তবায়িত হতো, তবে দেশেই এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহৃত হতো এবং পাটশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারত।
পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানির উন্নয়নের জন্য পাট চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভালো পাটের বীজ, পাট পচানো, পাট শুকানো, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোর উন্নতি প্রয়োজন। তা ছাড়া কৃষকের জন্য কাঁচা পাটের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত করতে হবে। পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারীরও উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। পাটশিল্পের মেশিনারিজ যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণ অত্যন্ত জরুরি, শ্রমিকদের ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। উৎপাদিত পাটজাত পণ্য যাতে বিশ্ববাজারে বিক্রি করা যায়, সেজন্য নতুন নতুন আন্তর্জাতিক বাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং যেসব বাজার হারিয়ে গেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারসহ যেসব বাজার বর্তমানে চালু রয়েছে—তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে।
এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিজেএমএ নিজেই একটি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। বিজেএমএর চেয়ারম্যান মো. আবুল হোসেন বলেছেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাট খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি উল্লেখযোগ্য খাত হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পরিকল্পনায় যেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে, তার কয়েকটি এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলো।
প্রথমত, বাংলাদেশের কাঁচা পাটের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কাঁচা পাটের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারিত হলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং মিল মালিকরাও কাঁচা পাটের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের পণ্যের উৎপাদন মূল্য নির্ধারণপূর্বক বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন। এ বিষয়ে পাট অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, কৃষক কর্তৃক দেশীয় উন্নত জাতের পাট বীজ উৎপাদন এবং পাট বীজ উৎপাদনে বিএডিসি, বিজেআরআই ও পাট অধিদপ্তরকে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করা এবং দেশীয় জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অধিক ফলনশীল, গুণগত মানসম্পন্ন আঁশ, রোগবালাইয়ের উপদ্রব কম হয় এমন জাতের পাট বীজ উৎপাদনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা। তৃতীয়ত, পাট উৎপাদনকারী এলাকায় পাটচাষিদের পাট চাষের পূর্ব ও পরবর্তী কার্যক্রমে সহায়তা, পাট চাষকে জনপ্রিয়করণ, পাটচাষিদের আয় বৃদ্ধি এবং পাটের মোট উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য ‘পাটের উন্নত চাষ ও পাট পচনের উন্নত পদ্ধতি বাস্তবায়ন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। যাতে এ প্রকল্পের আওতায় পাটচাষিরা শতভাগ প্রত্যায়িত বীজ পেতে পারেন। পাট অধিদপ্তর, বিএডিসি, বিজেআরআই যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চাষিদের মধ্যে উন্নত পাট বীজ বিতরণ ও চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার আগে চাষিদের পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সমিতির মাধ্যমে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদান করা হতো। স্বাধীন হওয়ার পর পাটচাষিদের এ সুবিধাটি আর প্রদান করা হয়নি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের প্রায় সব পাট মিল এবং মেশিনারিজ ৫০-৬০ বছরের পুরোনো বিধায় তা পরিবর্তন করে নতুন মেশিন কেনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মিল মালিকদের ৩০ শতাংশ হারে অনুদান প্রদান করা প্রয়োজন। এতে মিল মালিকরা পুরোনো মেশিনারিজ বিক্রি করে যে অর্থ পাবেন, তার সঙ্গে সরকারি অনুদান এবং নিজস্ব অর্থ যোগ করে নতুন প্রযুক্তির মেশিনারিজ ক্রয় করে মিলে স্থাপন করতে পারবেন। নতুন প্রযুক্তির মেশিনারিজ স্থাপনের মাধ্যমে মিলগুলোকে আধুনিকীকরণ করা যেতে পারে, এতে মিলগুলোর উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়ে পণ্যের একক মূল্যও কমে যাবে। তাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে আরও কম মূল্যে পাটপণ্য সরবরাহ করা যাবে ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাটপণ্য অন্যান্য দেশের পাটপণ্যের সঙ্গে এবং বিকল্প পণ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে পারবে। অচিরেই বাংলাদেশের পাট খাতের রপ্তানি আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
পঞ্চমত, রপ্তানি বাজার উন্নয়নের জন্য পাটপণ্য উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারকদের রপ্তানি উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক মেলা ও বিদেশে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি প্রেরণ করা প্রয়োজন। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোকে পাটপণ্যের প্রদর্শনী ও পাটপণ্যের গুণগত মানের দিকগুলো তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণার জন্য বলা যেতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দূতাবাসে নিয়োজিত কমার্শিয়াল কাউন্সিলররা এ কাজটি করতে পারেন।
ষষ্ঠত, পাটশিল্পকে গার্মেন্টস শিল্পের ন্যায় সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। গার্মেন্টস শিল্প তাদের পণ্যের কাঁচামাল কেনার জন্য স্বপ্ন ও সরল সুদে ঋণ পায়। যে ঋণের অর্থ দ্বারা তারা সহজে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারে। কিন্তু পাটশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কাঁচা পাট ক্রয়ে মিল মালিকদের ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে (যা চক্রবৃদ্ধি হারে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ দাঁড়ায়) গৃহীত ঋণ দ্বারা কাঁচামাল কিনতে হয়। পাটশিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কাঁচা পাটের ওপর ০.৫ শতাংশ উৎসকর দিতে হয়। তা ছাড়া পাটশিল্পে পাটপণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্যাট, ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। পাটশিল্পের জন্য কোনো সরকারি বাজেটরি ফ্যাসিলিটি নেই। জাতীয় বাজেটে পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক বা অন্যান্য কর্মচারীর কল্যাণ বা পাটশিল্পের কর্মপরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সরকারি বাজেটে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন বলে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজেএমএর প্রস্তুতকৃত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটি যদি সরকার বিবেচনায় নেয় এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের উৎপাদিত পণ্য মোড়কীকরণে দেশীয় শিল্পজাত পণ্য হিসেবে পাটজাত পণ্য ব্যবহার করে, তবে রাতারাতি না হলেও ধীরে ধীরে এ শিল্পটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। তা ছাড়া পাটশিল্প খাতে নতুন পণ্য ও নতুন বাজার সম্প্রসারণ খাতে গার্মেন্টসের ন্যায় সরকার নীতিগত ও আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে পারে।
লেখক: সচিব, বিজেএমএ
অতিরিক্ত সচিব (অব.)
(প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব)
মন্তব্য করুন