বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রকোপ কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিল, তখনই শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যার কঠিন প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ফিলিস্তিন- ইসরায়েল যুদ্ধ। এর প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ যুদ্ধও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমতাবস্থায় যদি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল হয়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি ধারাবাহিকভাবে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি দেয়, তবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেষ বিচারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর।
বৈশ্বিক নানা সংকটের মধ্যে এখন যুক্ত হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ দুটির অভিঘাত একটি অন্যটিকে আরও বড় করে তুলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটলে সেটিও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম হয়েছে নির্বাচন কেন্দ্র করে। ফলে সরকারের মনোযোগটা আরও বেশি বিচ্যুতি ঘটেছে। রাজনৈতিক দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে অর্থনীতিকে ঠিক করার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন সেদিকেই সরকারের এখন মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারের সব মনোযোগ এখন রাজনীতির দিকে দেওয়া ঠিক হবে না। মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে অনেক কষ্টে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ছে না বরং আরও সংকুচিত হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বন্দরে জাহাজ কম, পণ্যবাহী ট্রাকের পরিমাণ কম, কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা আগে থেকেই ছিল। এরপর এই নভেম্বর মাসে এটি কোন দিকে যাবে সেটি ভাবতেও ভয় করছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামগ্রিক সংকটকে কতখানি নিচে নামিয়ে দিতে পারে, সেটি নিয়ে আমরা শঙ্কিত।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, কিছু দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। আমরা পাকিস্তানকে দেখছি, আমরা শ্রীলঙ্কাকে দেখছি, আমরা সুদান, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দেখছি। আমাদের দেশে কখনো সেই সব দেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হোক, তা চাই না। কোনো দেশই সেটি চায় না। রাজনৈতিক সংঘাত একটি দেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় থাকে না। আমাদের উচিত বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সরকার এবং বিরোধীপক্ষ সবার একটি সমঝোতায় আসা। আমাদের উচিত রাজনৈতিক বিরোধকে রাজনৈতিক পন্থায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা। দুপক্ষই বলছে, রাজপথে মোকাবিলা হবে। এটি কোনো ধরনের সমাধান নয়। সমাধান হতে হবে পার্লামেন্টে, সমাধান হতে হবে সংলাপে। এখানে দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার আছে, স্বচ্ছতার ব্যাপার আছে, আছে অধিকারের ব্যাপার। এ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করার চিন্তা করাটা ঠিক হবে না। আর রাজনীতি যদি স্থিতিশীল না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটবে না। রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কোনো দেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ হবে না। কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা যাবে না এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিবেশটি আমরা চাই না; কিন্তু আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।
রাজনৈতিক সংঘাত এবং সহিংসতায় সম্পদের ক্ষতি হয়। মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আয় ও রুজিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি কে বহন করবে? এ বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হবে। একই সঙ্গে কাউকে বাদ দিয়ে আমরাই সব দখল করব, সেটিও সঠিক নীতি নয়। একটা অধিকার বণ্টনের বিষয় রয়েছে, সবাইকে অধিকার দিতে হবে। সবাইকে তার অবস্থান দিতে হবে। গায়ের জোরে টিকে থাকা কোনো সমাধান নয়।
রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও আস্থার জায়গা না থাকলে এবং আলোচনা-সমঝোতার সুযোগ ব্যর্থ হলেই অস্থির পরিস্থিতির অবতারণা হয়। রাজনৈতিক চর্চা যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে করতে হয়, সেটি যদি রাজনীতিবিদরা করতে না পারেন, তাহলে আর কিছু বলার থাকে না। রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। একটি দল ক্ষমতায় থাকবে, আরেকটি দল বিরোধী অবস্থানে থাকবে। সবার রাজনৈতিক চর্চাই হবে দেশের স্বার্থে কাজ করা। এটি তারা মাঝেমধ্যেই ভুলে যান বলে দেশকে কিছুদিন পরপর একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে চান, যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। কোনো অবস্থাতেই সংঘাত যাতে দীর্ঘ না হয়, সে চেষ্টা চালাতে হবে। সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান হোক। দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এখন রাজনীতির নামে যা শুরু হয়েছে, তা চলতে থাকলে অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতি খারাপ হলে সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। হরতাল-অবরোধ ও সংঘাতের কারণে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হলে সেখানে বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা দেশে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। সব মিলে সমঝোতার রাস্তা তৈরি না হলে সামনের সময় খারাপ হবে। এখানে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকায় দেখা না গেলে অর্থনীতিকে চরম মাশুল দিতে হবে, যার থেকে উত্তরণে দেশকে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)
শ্রুতলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম