প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:০০ এএম
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চ্যালেঞ্জ পুরোনো, দায়িত্ব নতুন

চ্যালেঞ্জ পুরোনো, দায়িত্ব নতুন

গত ১১ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। শপথের আগে থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছিল, কে বাদ পড়েছেন, কে নতুন ঢুকেছেন তার ইতিবৃত্ত। তবে টেকনিক্যালি বিষয়টা ঠিক নয়। ১১ জানুয়ারি যে মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে, তা নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রিসভা। আগের সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যদি সরকারের মাঝপথে কেউ বাদ পড়তেন, সেটাকেই আসলে বাদ পড়া বলা সংগত। টেকনিক্যালি ঠিক না হলেও ব্যাপকভাবে বাদ পড়ার হিসাব-নিকাশই করা হয়। কে কেন বাদ পড়লেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়।

বাদ পড়ার কথা যদি বলতেই হয় তাহলে অনেক আগেই আগের সরকারের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাদ পড়া উচিত ছিল। আগের সরকারের অনেকটা সময় কার্যত অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মোস্তফা কামাল অনুপস্থিত ছিলেন। দেশের অর্থনীতি যখন প্রবল সংকটে, তখন অর্থমন্ত্রীর অনুপস্থিতি সংকটকে আরও জটিল করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ ছিলেন। তিনি বারবার নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন, যার মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অর্থমন্ত্রীর অনুপস্থিতি আর বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতা সরকারকে এবং দেশের মানুষকে ভুগিয়েছে অনেক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের অসংলগ্ন কথাবার্তা বারবার সরকারকে বিপাকে ফেলেছে। সরকারের ওপর নানামুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও নানামুখী দুর্নীতির কবলে নিমজ্জিত ছিল।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার গঠন দেখলেই সরকারের অগ্রাধিকারগুলো বোঝা যায়। অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে নতুন মুখ এনে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন তার চাওয়া। সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। তবে তার আগে ঠিক করতে হবে অর্থনীতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল। কিন্তু কভিড এসে প্রথম অর্থনীতির গতি আটকে দেয়। কভিডের ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আবার পেছনে টেনে ধরে। অবশ্য সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক সংকটের অভিঘাত লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। রিজার্ভ কমছে আশঙ্কাজনক হারে। ডলারের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে সাধারণ মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে আগেই। অনেক দিন পর বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের সামনে এখন তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতিকে আবার গতিশীল করা। মোস্তফা কামাল যে বাদ পড়ছেন, এটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু কে হবেন নতুন অর্থমন্ত্রী, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল সব মহলে। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট আবুল হাসান মাহমুদ আলী পেয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এর আগে যিনি একবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট হলেও মাহমুদ আলী অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। এটুকুই ভরসা। তবে প্রবীণ মাহমুদ আলীকে আমার কাছে ঠিক ক্যারিশম্যাটিক মনে হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়ও তিনি খুব বড় কিছু দেখাতে পারেননি। রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর সময়টায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তাকে ঠিক সফল বলা যাবে না। অর্থনীতি এখন যে জটিল অবস্থায় আছে, তা থেকে পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন ছিল সাহসী ও ক্যারিশম্যাটিক কাউকে। যিনি ঝুঁকি নিতে পারবেন, আউট অব দ্য বক্স ও সৃষ্টিশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন সাহসের সঙ্গে। আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। তবে তিনি ট্র্যাডিশনাল পথের বাইরে যেতে সাহসী হবেন বলে মনে হয় না।

অর্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা, সেখানেও প্রধানমন্ত্রী আস্থা রেখেছেন অভিজ্ঞতায়। তবে আশি পেরোনো অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম পরিকল্পনায় কতটা অভিনবত্ব ও সৃষ্টিশীলতা আনতে পারবেন, তা নিয়েও সংশয় রয়েই গেছে। সবচেয়ে বড় যেই চ্যালেঞ্জ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সেখানে প্রধানমন্ত্রী তুলনামূলক তারুণ্যে ভরসা করেছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু প্রথম বৈঠকেই বাজার নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। তিনি অর্থ, খাদ্য, কৃষি এবং মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন। আহসানুল ইসলাম টিটু নিজেও একজন ব্যবসায়ী। তবে তিনি ব্যবসায়ী নয়, জনগণের স্বার্থে কাজ করার কথা বলেছেন। বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তো চ্যালেঞ্জ বটেই, তবে তার সামনে জরুরি চ্যালেঞ্জ হলো রমজানে বাজার সহনীয় রাখা। তার হাতে সময় একদম কম। তবুও রমজানই হবে নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর জন্য অ্যাসিড টেস্ট। এ টেস্টে উতরাতে পারলে সামনে তাকে লম্বা টেস্ট ইনিংস খেলতে হবে। বলা ভালো, আহসানুল ইসলাম টিটুর ওপরই সরকারের প্রাথমিক সাফল্য-ব্যর্থতার ভার।

বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণের আরও দুটি মন্ত্রণালয় হলো কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল পিলারের একটি হলো কৃষি। কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করেন বলেই শত সংকটেও আমাদের পাতে ভাতের অভাব হয় না। তবে বরাবরই কৃষকরা আমাদের এখানে অবহেলিত। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। আশা করি তিনি মমতা নিয়ে কৃষকদের পাশে থাকবেন। কৃষি ও কৃষকরা ঠিক থাকলে আর যাই হোক, আমাদের ভাতের অভাব হবে না। তবে শুধু ভাতেই এখন আর আমাদের হয় না। একসময় ‘দুবেলা দুমুঠো ভাতে’ সন্তুষ্ট বাঙালি এখন মাংস খাওয়ার স্বাধীনতা চায়। এই মাছ-মাংস-ডিম-দুধের জোগান দেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আরেক পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ আব্দুর রহমান। সরকার আমলা আর ব্যবসায়ীনির্ভর হয়ে যাচ্ছে, এ অভিযোগের বিপরীতে এবার মন্ত্রিসভায় রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ বেশি। আশা করি ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানরা এবার তাদের পারফরম্যান্স দিয়ে রাজনীতিকে আবার রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে দেবেন।

এবারের মন্ত্রিসভার সত্যিকারের চমক হলেন সামন্ত লাল সেন। বছরের পর বছর নিষ্ঠার সঙ্গে আগুনে পোড়া মানুষদের চিকিৎসা করে সামন্ত লাল সেন নিজেকে অন্যরকম উচ্চতায় তুলে এনেছেন অনেক আগেই। তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট এখন সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। সামন্ত লাল সেনের সতত, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। আমার ভয়, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর অধিদপ্তর নিয়ে। প্রবল প্রতাপশালী সিন্ডিকেটের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি কতটা পারবেন, তা নিয়ে। বার্ন ইনস্টিটিউটের কারণেই সামন্ত লাল সেনের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে সফল হলে তা আরও উজ্জ্বল হবে। তবে ভয়টা আমার যাচ্ছেই না।

সাফল্যের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয় সামলানো ড. হাছান মাহমুদ এবার পেয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলানোর দায়িত্ব। এ মন্ত্রণালয়ে তিনি একেবারে নতুন নন। ২০০৯ সালের সরকারে তিনি অল্প কিছুদিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তার সামনে এবার অন্যরকম চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির বাইরে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কূটনীতি। আগের সরকারের শেষ সময়টায় সরকারকে নানামুখী কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামলাতে হয়েছে। বিশেষ করে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নানা পদক্ষেপ বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলেছে বারবার। র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে মারাত্মকভাবে। অনেকের শঙ্কা ছিল নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনো পদক্ষেপ নেবে। এখনো তেমন কোনো আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে চ্যালেঞ্জ হলো আগে যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেরামত করে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করা।

সরকার নতুন হলেও চ্যালেঞ্জগুলো পুরোনো এবং চেনা। তবে চেনা হলেও সব চ্যালেঞ্জ চেনা রাস্তায় উতরানো যাবে না। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চাই নতুন উদ্যোগ, নতুন রাস্তা, চাই সৃষ্টিশীলতা, চাই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। নতুন দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রীরা নিশ্চয়ই পুরোনো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে আবার সমৃদ্ধির ধারায় তুলে আনবেন। সে আশায় বুক বেঁধে আছে গোটা জাতি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু মঞ্চ ও পোশাক কর্মশালা

এবার চতুর্থ সারির ক্লাবের কাছে হেরে ম্যানইউর বিদায়

ড. মাসুদের প্রচেষ্টায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেলো ৩ ইউনিয়নের মানুষ

বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশ স্পিনার

রুমিন ফারহানার দুঃখ প্রকাশ

বৃহস্পতিবার প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা

ভারতে নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া, বড় ধাক্কায় আইপিএল ও ভারতীয় ক্রিকেট

পদক্ষেপ নিলে মনে হয় দেশেই থাকা হবে না : ডিসি মাসুদ

রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভা

ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১–এর কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবি

১০

জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য: উপদেষ্টা

১১

কনভেনশন হলে গেরিলা বৈঠকে গ্রেপ্তার শিমুল ৪ দিনের রিমান্ডে

১২

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

১৩

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

১৪

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

১৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

১৬

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৭

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

১৮

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

১৯

একাধিক উপকারিতা কাঠবাদামের, যাদের জন্য ক্ষতিকর

২০
X