জাকির হোসেন
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভাষার লড়াই এবং লড়াইয়ের ভাষা

ভাষার লড়াই এবং লড়াইয়ের ভাষা

আমাদের জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক তাৎপর্যে দুটি ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, অন্যটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এ দুটি ঘটনার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা ততটা বিস্তৃত হয়নি, গুরুত্বের বিচারে যতটা হওয়া উচিত ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি প্রথম প্রতিবাদ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠা, প্রথমবারের মতো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী বোধে উজ্জীবিত হওয়া। ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হয় বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ভাষা হিসেবে। ফলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার রাষ্ট্র। স্বাধীন দেশেও গত পাঁচ দশকে বিভিন্ন সময়ে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ‘ভাষার লড়াইয়ের সেই চেতনা’ লড়াইয়ের ভাষা হয়ে এ দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছে।

একুশের চেতনা বাংলাদেশের রাজনীতি, সাংস্কৃতিক চেতনা, সমাজবোধ ও অর্থনৈতিক ভাবনাকে প্রভাবিত করে এসেছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনার মোড় পরিবর্তনের সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক ছিল এবং আছে।

একুশ এ দেশের মানুষকে স্বৈরাচার ও গণবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহসী করেছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ দেশের মানুষ শহীদ মিনারে শপথ নিয়েই পথ চলেছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশেও একুশ ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে, নাটকে, গানে, চিত্রকলায় এবং সংস্কৃতির সব মাধ্যমে একুশের প্রভাব অনেক বেশি ও প্রসারিত। একুশ আমাদের শিখিয়েছে আধুনিক মানসিকতা।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরা ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। কালের বিবর্তনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে আমাদের মিলিত চেতনার স্থান। ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত এই শহীদ মিনার আমাদের স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জুগিয়েছে প্রেরণা। ’৬৬-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে যেমন সংগ্রামী মানুষের আধার ছিল এই শহীদ মিনার। তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামে শত্রুর পাশবিক থাবায় আহত এই শহীদ মিনার ৯ মাস এ দেশের মানুষের প্রাণে জুগিয়েছে মুক্তির সংগ্রামী চেতনা—শুনিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের অভয় বাণী। আবার স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ এ দেশের প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে এই শহীদ মিনারের পাদপীঠ থেকেই।

কিন্তু ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাত দশক অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও নকশা অনুযায়ী পূর্ণতা পায়নি এই শহীদ মিনার। আজও তা রয়ে গেছে অপূর্ণ। শহীদ মিনারের বর্তমানের অপূর্ণ রূপটিও পরিগ্রহ করেছে নানা বিবর্তনের মাধ্যমে। আজ যেখানে শহীদ মিনারটি দাঁড়িয়ে আছে এখানেই ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথম গুলি চালানো হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি এখানে তৈরি করা হয়েছিল একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ওইদিন (২২ ফেব্রুয়ারি) সূর্যাস্তের সময় ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন নেতাকর্মীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাতে ইট-সুরকি, সিমেন্ট ও অন্যান্য মাল-মসলা জোগাড় করে ভাষা আন্দোলনের প্রাণচাঞ্চল্য তরুণরাই সারা রাত ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করেন। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে যিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য পদ হতে ইস্তফা দিয়েছিলেন দৈনিক ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন যুব-ছাত্র-জনতার কৃতজ্ঞতাভাজন হন, তেমনি অন্যদিকে তৎকালীন সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে চুরমার করে দেয়।

এরপর ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার তাদের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তিস্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আতাউর রহমান খান শহীদ মিনারের ব্লু-প্রিন্ট ও ডিজাইন তৈরির জন্য প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রহমানকে নিযুক্ত করেন। শহীদ মিনারের অঙ্গশোভা পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসান। স্থপতি হামিদুর রহমানের মূল নকশা ছিল এরূপ—

স্তম্ভগুলোর সামনের চত্বরের মধ্যস্থলে একটি সরোবর, সরোবরে রক্তকমল শাপলা, স্তম্ভগুলোর অবনত মাথার ছায়া, স্তম্ভের মধ্যবর্তী ফাঁকে ফাঁকে শিক, মূল শহীদবেদির দুই পাশে দুটি সবুজ কামরা, এর একটি পাঠাগার, অন্যটি জাদুঘর। মূল চত্বরের বাইরে একটি বেদি। উঁচু বেদি হবে সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের স্থান।

এ বিষয়ে স্থপতির ব্যাখ্যা হলো—মূল বেদি হচ্ছে জন্মভূমি। অবনত মাথা স্তম্ভসমূহ এবং পাশেরগুলো হলো জনতা। স্বচ্ছ পানি শহীদদের আত্মার প্রতিকৃতি। রক্তকমল শাপলা হলো আত্মদানের প্রতীক। সরোবরে অবনত শিরের ছায়া হচ্ছে শহীদদের আত্মদানের প্রতি দেশবাসীর কৃতজ্ঞতা।

আতাউর রহমান খানের সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নে দক্ষতার পরিচয় দিলেও দুই বছরের অধিক ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও স্থপতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অঙ্কিত নকশা মোতাবেক শহীদ মিনার নির্মাণের চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষী গভর্নর লে. জে. আজম খান বর্তমান শহীদ মিনারটি নির্মাণের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা ওই মিনারটি উদ্বোধন করেন। লে. জে. আজম খান নির্মিত এ শহীদ মিনারটি ছিল স্থপতি হামিদুর রহমান কর্তৃক অঙ্কিত নকশার আংশিক বাস্তবায়ন মাত্র।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে এ শহীদ মিনার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ ঘটনায় মারা যান শহীদ মিনারের প্রহরী দেলোয়ার হোসেন, সালাহ উদ্দীন ও রইছ আলী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী জাতির আনন্দ অশ্রুতে মুছে যায় শহীদ মিনারে আঘাতের যাতনা। আয়োজন করা হয় সংগ্রামী প্রেরণার অক্ষয় মিনার দৃঢ়তার ভিত্তিতের স্থাপনের আয়োজন।

রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিষদ গঠিত হয়। একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মিনারের জন্য নকশা বাছাই করে এ পরিষদ। প্রতিদ্বন্দ্বী ১২টি নকশার মধ্যে শিল্পী হামিদুর রহমান ও জাফরের নকশা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। সেই নকশা অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে এই নকশা অসম্পূর্ণ বিবেচিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৭৬ সালের জুন মাসে শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদকে মিনারের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। স্থপতি ড. এম এ মুকতাদির, হাবিবুর রহমান, শামসুল ওয়ারেস ও খায়রুল আনাম কর্তৃক প্রস্তাবিত তিনটি নকশার মধ্যে সরকার একটি গ্রহণ করেন। এটিই মূল নকশা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কাজটি করা হয়নি। ‘গৃহীত নকশায় বর্ধিত উচ্চতর মিনার, বেদিসংলগ্ন পশ্চিমের জমিতে একটি গ্যালারি জাতীয় নিচু ভবনের মধ্যে দেয়ালচিত্র, ভাস্কর্য ও লেখার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষিত হবে, চত্বরের উত্তর সীমায় খণ্ড খণ্ড দেয়াল (এখানে একুশের গান, কবিতা, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য থাকবে) ইত্যাদির কথা বলা হয়।

জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপূর্ত বিভাগ মূল নকশার বিষয়গুলো এড়িয়ে একটি নকশা তৈরি করে এবং ওই নকশা অনুযায়ী ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ কাজে নিযুক্ত হয় জুবিলী ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচশ লোক দিন-রাত পরিশ্রম করে ২১ ফেব্রুয়ারির আগে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২১ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২১ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

রাজশাহীতে দুই ছিনতাইকারী জনতার হাতে ধরা

ফয়জুল করিমকে মেয়র ঘোষণার দাবিতে গণমিছিল

নবাবগঞ্জ প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন

স্বর্ণালংকার নিয়ে চম্পট গৃহকর্মী, অতঃপর...

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ফেরিওয়ালা নিহত

দ্রুতগতির মোটরসাইকেল কেড়ে নিল যুবকের প্রাণ

জামায়াতে যোগ দেওয়া সেই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল বিএনপি

১০

‘সংস্কার ও বিচারের পর নির্বাচন চায় জামায়াত’

১১

চেক প্রতারণার মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

১২

টঙ্গীতে যুবককে কুপিয়ে হত্যা

১৩

যশোরে ২৮ মন্দিরে অনুদানের চেক বিতরণ

১৪

২০ লিটার দুধ দিয়ে যুবকের গোসল, নেপথ্যে কী?

১৫

পারভেজ হত্যার ঘটনায় ঘৃণ্য রাজনৈতিক অপপ্রচার চালাচ্ছে ছাত্রদল : উমামা ফাতেমা

১৬

ভূমি-কৃষি সংস্কার ও পরিবেশ সুরক্ষা কমিশন গঠনের দাবি

১৭

নিরাপদে পথচারী পারাপারে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু

১৮

রাব্বির গোলে জিতল বাংলাদেশ

১৯

কিশোরগঞ্জে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

২০
X