ভাষা আন্দোলন দমনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে গুলি চালিয়ে ছিল, এর অন্যতম রক্তাক্ত দলিল ভাষাশহীদ রফিকউদ্দিন আহমেদের ছবি। এই ছবিটি তুলেছিলেন ভাষাসংগ্রামী আমানুল হক। ওইদিন তার সঙ্গে মেডিকেল কলেজের বারান্দার সামনে দেখা হয় পূর্ববাংলা প্রচার দপ্তরের তৎকালীন সহকারী পরিচালক খ্যাতিমান সাংবাদিক মোহাম্মদ ইদ্রিসের সঙ্গে। পুলিশের গুলিতে নিহত রফিকউদ্দিনে ছবি তোলার ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ছাত্রদের অনেকে তখনো হাসপাতালের মেঝের ওপর শোয়া। চারদিকে একটা দারুণ উত্তেজনা। ওই সময় নুরুদ্দিনের স্ত্রী হালিমার সঙ্গে মোহাম্মদ ইদ্রিসের দেখা হয় (পরবর্তী সময়ে গ্রিন অ্যান্ড হোয়াইটের নুরুদ্দিন আহমদের স্ত্রী ডা. হালিমা খাতুন-লেখক)। তিনি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। অ্যাপ্রোন পরা অবস্থায় খুব ব্যস্ত। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি মোহাম্মদ ইদ্রিসকে বলেন, ছাত্রটির মাথার খুলি উড়ে গেছে, তার দেহ হাসপাতালের পেছন দিকে একটি ঘরে রাখা আছে। তিনি বলেন, ইচ্ছা করলে মৃতদেহ দেখাতে পারেন। মোহাম্মদ ইদ্রিস তৎক্ষণাৎ রাজি হন এবং ডা. হালিমা খাতুন খুব সাবধানে মোহাম্মদ ইদ্রিসকে পেছনের দিকে সেই নির্দিষ্ট কামরায় নিয়ে যান। মোহাম্মদ ইদ্রিস দেখলেন ছেলেটির মাথার খুলি উড়ে গেছে। তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি তখন ডা. হালিমা খাতুনকে জিজ্ঞেস করেন, মৃতদেহটির ছবি তোলা যায় কি না এবং তিনি তার ব্যবস্থা করতে পারবে কি না। তিনি বলেন, লুকিয়ে তাড়াতাড়ি এক মিনিটের মধ্যে কেউ যদি সে কাজ করতে পারে তার পক্ষে ব্যবস্থা করা সম্ভব। মোহাম্মদ ইদ্রিস মেডিকেল কলেজের বারান্দা থেকে সামনে মাঠের মধ্যে এসে আমানুলের দেখা পান। তখন তিনি ফুলহাতা হাওয়াই শার্ট পরেছিলেন এবং সেই শার্টের মধ্যে তার একটি ক্যামেরা লুকানো ছিল। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাটি এনেছিলেন। কিন্তু ছবি তোলা সে সময় বিপজ্জনক হতে পারে মনে করে ক্যামেরাটি লুকিয়ে রেখে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। মোহাম্মদ ইদ্রিস পুরো ব্যাপারটি বর্ণনা করে ছবি তোলার প্রস্তাব দেন। আমানুল হক তখনই রাজি হয়ে যান। এরপর মোহাম্মদ ইদ্রিস ডা. হালিমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলেন। ঠিক হলো যে, মোহাম্মদ ইদ্রিস আমানুল হকের সঙ্গে যাবেন না। আমানুল হক একাই যাবেন এবং মেডিকেল কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডা. হালিমা খাতুন ইশারা করলে তার কাছে যাবেন। এরই মধ্যে আমানুল হক তার ক্যামেরা ঠিকঠাক করে আনতে কোনো জায়গায় গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এলে তাকে মোহাম্মদ ইদ্রিস সব বলেন এবং ডা. হালিমা খাতুনকে দূর থেকে চিনিয়ে দেন। এরপর ডা. হালিমা খাতুন একবার ইশারা করায় তিনি তার কাছে যান এবং ভেতরের দিকের কামরায় গিয়ে ছবিটি তাড়াতাড়ি তুলে আনেন। এসে বলেন, ছবি ভালো আসবে। মোহাম্মদ ইদ্রিস সন্ধ্যার সময় আমানুল হকের বাড়ি গিয়ে দেখেন ছবিটি খুব ভালো উঠেছে, ছবিটির কয়েক কপি করা হয়েছিল। তার মধ্যে এক কপি নিয়েছিল স্পোর্টস ফেডারেশনের এএসএম মহসিন (সাজু), একটি কপি দেওয়া হয়েছিল মাজেদ খানকে (ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং আরেকটি দৈনিক আজাদে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আজাদে ওটা ছাপানোর ব্যবস্থাও হয়েছিল। ছবিটির ব্লকও এসেছিল। কিন্তু রাত প্রায় ২টার সময় কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে সেটি শেষ পর্যন্ত আর ছাপা হয়নি। মাজেদ খানের কাছে যে কপিটি ছিল, তা থেকেও ব্লক তৈরি করা হয়েছিল। সে ব্লকটি মাজেদ খানের মাধ্যমেই ছাত্রদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্ররা একটি প্রচারপত্র লিখে তাতে ছবিটি ছেপেছিল। এই প্রচারপত্র পরে পুলিশের হাতে পড়ায় সব সিজ করে বাজেয়াপ্ত করা হয়।