রাজধানীতে একের পরে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সাধারণ মানুষ মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের অন্যমত কারণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং যথাযথ নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ। বলা বাহুল্য, এসব ভবনের অধিকাংশই গড়ে তোলা হয়েছে ব্যবসা এবং মুনাফার বিষয়টি মাথায় রেখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখানে মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। কেননা আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী মুনাফা বোঝেন, মনুষ্যত্ব বোঝেন না। মনুষ্যত্বের বোধ তাদের কাছে মুখ্য নয়, গৌণ। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু তাদের হৃদয়কে বিশেষভাবে নাড়া দেয় না। আর দেয় না বলেই এ শহরে আগুনের লেলিহানে মানুষের মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনা।
রাজধানীতে গত ১৪ বছরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৭ জনের। নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর ঢাকা ট্র্যাজেডির খাতায় নতুন করে নাম লেখালো বেইলি রোড। এ ছাড়া বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল কালবেলায় প্রকাশিত ‘অগ্নিবোমা ২৫০০ ভবন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অপরিকল্পিত বহুতল ভবনের যে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, এতে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব এবং নৈতিকতা বোধের এক নগ্নচিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। সেইসঙ্গে জানান দিয়েছে আমাদের নাগরিক জীবনে ওত পেতে থাকা এক ভয়ানক বিপদের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য। এতে সহজেই বোঝা যায়, আমরা কী ভয়ানক একটি পরিস্থিতির মধ্যে দিন যাপন করছি।
ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকাজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের দিক থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ২ হাজার ৫১২টি। অনেকটা ‘অগ্নিবোমা’ হয়ে থাকা এসব ভবনে চলছে নানামুখী কার্যক্রম। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৮টি ভবনে রয়েছে মার্কেট ও শপিংমল। অন্যগুলো হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া হাউস। এসব ভবনে আগুন লাগলে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ, পুরান ঢাকার নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে রূপ নিতে পারে। অর্থাৎ আমরা যদি নিজেদের না পাল্টাই তবে ভবিষ্যতে আমাদের আরও এমন মর্মান্তিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হবে। একজন নাগরিক হিসেবে এর চেয়ে উদ্বেগের খবর আর কীই বা হতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটা ভবনটির সংশ্লিষ্টদের তিনবার নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটেও অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেষ পর্যন্ত আগুনে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে নোটিশ পাওয়ার পর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
বিশ্বায়ণের এই রমরমা সময়ে অতিসম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এক সূত্রে বাঁধা পড়েছিল গোটা পৃথিবী। ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি, পর্যটন সব ছাপিয়ে গত দুই বছর বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল করোনা মহামারির দাপটের খবর। করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে মহামারির প্রসঙ্গ ভিড় করতে শুরু করে অনেকের স্মৃতিতে। সবাইকে নতুনভাবে মনে করিয়ে দেয় আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের কথা। মনে করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধকে আমরা মনে রাখি, সম্ভবত তা আমাদের নায়ক এবং জয়ের কাহিনি শোনায় বলে। কিন্তু দুর্ঘটনা ও মহামারির তো নায়ক নেই। শুধু আছে অদেখা, অদৃশ্য একটা শক্তি, যা গণহারে মৃত্যু ঘটায়। তবু যেন কিছুই পাল্টায় না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন, এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মেলে না...