যেসব সাফল্য গাঁথা ইতিহাসের পাতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনন্য উচ্চতায় ঠাঁই করে দিয়েছে, তার অন্যতম ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অনবদ্য ও ঐতিহাসিক ভাষণ। ইতিহাসের গতি পাল্টে দেওয়া সেই ভাষণে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্বায়ত্তশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতিসহ নানা বিষয় ঠাঁই পায়। এসব বিষয় নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা, বিশ্লেষণ ও আলোচনা হয়েছে, যা আজও বহমান এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। তবে সেই অসাধারণ ভাষণের সামরিক গুরুত্ব খুব একটা আলোচনায় আসেনি। অথচ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষণটির কিছু অংশ বিশ্লেষণ করলেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে একজন পরিপক্ব সমর দার্শনিক ও সামরিক নেতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
সামরিক বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এবং পরবর্তীকালে মৌখিক বা লিখিত আকারে যুদ্ধের আদেশ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানোর জন্য শুরুতেই সুস্পষ্ট করে জানানো হয় আসন্ন অভিযান বা যুদ্ধের উদ্দেশ্য। ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেন সুস্পষ্ট তিনটি উদ্দেশ্য। তার ভাষায়—‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ সামরিক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের আলোকে রচিত হয় কর্মপরিকল্পনা। আর এ ক্ষেত্রে পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকাই যে মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল, তা প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পড়তে পড়তে। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধান রচনার সময় এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেশ পরিচালনার মৌলিক নীতিগুলো সাজানো হয়।
একটি সমর পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য স্পষ্ট করার পর একজন অধিনায়ক যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ শত্রুর স্বরূপ তুলে ধরেন। ৭ মার্চের ভাষণে শত্রু পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু একে একে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ফলকে গুরুত্ব না দেওয়া, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের বাইরে রাখা, আমাদের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে আমাদেরই নির্বিচারে হত্যা করা, আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি তুলে ধরেন।
যুদ্ধ পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য ও শত্রু পরিস্থিতির ব্যাখ্যার পর মূল্যায়ন করা হয় নিজ শক্তি সামর্থ্যের বিষয়টি। ৭ মার্চের ভাষণে আত্মমূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেদের অখণ্ড পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি হিসেবে তুলে ধরেন। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ এবং ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না’ বলে বঙ্গবন্ধু তার মোট ঘাঁটি ও সৈন্য সংখ্যার জানান দেন।
উদ্দেশ্য ও শত্রু-মিত্র পরিস্থিতি ব্যাখ্যার পর একজন সমরবিদ ব্যাখ্যা করেন কার্যসম্পাদন পদ্ধতি নামে পরিচিত যুদ্ধ পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সামরিক পরিভাষায় এ অংশটিকে টাস্ক বা ‘মোদাস অপারেন্ডি’ বলা হয়। ৭ মার্চের ভাষণে ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধ পরিকল্পনার নানা দিক।
‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’—বলে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের কৌশল বাতলে দেন। এ নির্দেশনা পেয়ে একদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (সীমান্তরক্ষী), পুলিশ ও আনসারের সশস্ত্র সদস্যরা বুঝে যায় যে সময় হয়েছে, তাদের এখন অস্ত্র নিয়ে ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং লড়াই করতে হবে। আর সাধারণ মানুষ দা, বল্লম, তীর-ধনুক এমনকি লাঠি হাতেও দাঁড়িয়ে যায়, যার সম্মিলিত শক্তি কোনো অংশেই একটি প্রশিক্ষিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর শক্তির চেয়ে কম নয়। এ প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা এবং পরবর্তীকালে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হো চি মিন মার্কিন সেনাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, তোমাদের প্রতিজনকে হত্যার কারণে তোমরা আমাদের ১০ জনকে হত্যা করতে পার। তবে এমন প্রতিকূল অবস্থাতেও তোমরা পরাজিত হবে আর আমরা হব বিজয়ী। হো চি মিন মিনের সেই তত্ত্ব সত্য প্রমাণ করেছিলেন জাতির পিতা।
শত্রুকে ঘায়েল করার অন্যতম রণকৌশল হলো তার সামরিক ও প্রশাসনিক সরবরাহব্যবস্থা অকার্যকর করে দেওয়া, যাতে শত্রু যুদ্ধ ও প্রশাসন চালিয়ে যাওয়ার এমনকি সাধারণ জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সংকটে পড়ে। সমরবিদদের ভাষায় এ হলো মাছকে পানি থেকে তুলে নেওয়া কৌশল, যা ক্রমেই শত্রুকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আবার পশ্চিমা সমরবিদরা এ কৌশলকে বলেন অবরোধ বা প্রতিবন্ধকতা পরিকল্পনা (ডেনিয়াল প্ল্যান)। এ কৌশল বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।’ এভাবে তিনি একপ্রকার গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশনা দেন এই ভাষণের মধ্য দিয়ে।
বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের জন্য মাও জে দংয়ের খ্যাতনামা দর্শন হলো—‘শত্রু যখন ক্লান্ত হয়ে পিছু হটবে ও নিজেদের সংকুচিত করবে, তখন তাকে ধাওয়া করো এবং আঘাত করো। আর শত্রু যখন এগোবে, তখন তার চলাচলের পথে অসংখ্য ছোট ছোট বাধা সৃষ্টি করো এবং নিজেরা চলে যাও নিরাপদ স্থানে।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা ও যা যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করা নির্দেশনা ছিল এমন গেরিলা যুদ্ধের কৌশলেরই প্রতিফলন।
সামরিক আদেশের অপরিহার্য বিষয় বিকল্প নেতৃত্ব, যা বক্তব্যের এই অংশে ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি’ বাক্যটির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বিকল্প নেতৃত্ব এবং দ্বিতীয় সারির সেনা বা ‘রিজার্ভ ফোর্স’ নামে পরিচিত সামরিক শক্তি নিয়ে জাতির পিতার ভাবনা উঠে আসে তার প্রত্যেক গ্রামে প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশে। এখানে লক্ষণীয়, এই বক্তব্যের আগের অংশে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার কথা বলার পর তিনি অন্যদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন, যা শুধু একজন দূরদর্শী সমরনায়কের পক্ষেই সম্ভব।
যে কোনো রণক্ষেত্রে যোগাযোগব্যবস্থা তথা বেতার বা তারের সাহায্যে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি একদিকে গণমাধ্যমকে শত্রুর প্রোপাগান্ডা প্রচারে বাধা দেন। অন্যদিকে নিজেদের যোগাযোগের জন্য তার বা টেলিফোননির্ভর যোগাযোগের নির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন।’
একটি সেনাবাহিনীর মূল শক্তি তার নিজস্ব ঐক্য ও সংহতি। জাতির পিতা এ প্রসঙ্গে এক অবিস্মরণীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘শত্রু বাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে। আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ এ ক্ষেত্রে বাঙালি তথা পাকিস্তান সমর্থক বিহারিদের রক্ষার নির্দেশনা প্রদান করেন। একই সঙ্গে তিনি যে কোনো সামরিক বাহিনীর জন্য চরম ক্ষতিকর পঞ্চম শক্তি বা ‘ফিফথ কলামিস্ট’ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেন।
৭ মার্চের ভাষণের অন্য অংশে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি এবং অস্ত্রধারীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না’ ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ প্রণীত ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্টের ঐতিহাসিক জেনেভা কনভেনশনের একাধিক ধারার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, যা একজন বিবেকবান ও পেশাগত সমরবিদের অবশ্য কর্তব্যের অংশ।
তবে ৭ মার্চের ভাষণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, তিনি কমান্ডোদের ‘হয় শত্রুর দমন না হয় মরণ’ মন্ত্র বাতলে দেন। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তার দুটি অজেয় বাণী—‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না’ এবং ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’—যেন একদল কমান্ডারের প্রতি এক অকুতোভয় সমরনায়কের শেষ বার্তা।
আগেরকার দিনে পতাকা তুলে, ঢোল পিটিয়ে বা পশুর শিঙায় ফুঁ দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার মতো তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সংকেত দিলেন এই বলে—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’
উল্লেখ্য, ৭ মার্চের ভাষণকে ভিত্তি করে ১৪ মার্চ জাতির পিতা ৩৫টি নির্দেশনা জারি করে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যা ছিল মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রশাসনিক নির্দেশনাবলি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট