জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিশ্বের দেশে দেশে ক্রমেই প্রকাশ্য রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জলবায়ু সম্মেলন থেকে এ যাবৎ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে মূলত দুটি বিষয়ে। প্রথমত বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং দ্বিতীয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে, সন্দেহাতীতভাবে সেগুলোর জন্য দায়ী উন্নত ধনী দেশগুলোর ভোগবিলাসী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নির্বিচার শিল্পায়ন। জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন জোট, এনজিও, প্রেশার গ্রুপ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে হলেও নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নত এবং ধনী দেশগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো, কার্বন নিঃসরণ রোধের ক্ষেত্রে বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এরকম বাস্তবতায় ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের নীতিগত অনুমোদন একটি যুগান্তকারী সাফল্য বলতেই হবে।
দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতু ১৯৯১ সালে প্রথম ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের প্রস্তাব উত্থাপন করে। ২০০৭ সালে ১৩তম জলবায়ু সম্মেলনে বালি কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ক্ষয়ক্ষতি তহবিল আনুষ্ঠানিক আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ওয়ারশ সম্মেলনে (কপ-১৯) ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ‘ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম’ (WIM) গ্রহণ করা হয়। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির (কপ-২১) আর্টিকেল-৮-এ ক্ষয়ক্ষতি তহবিল সম্পর্কে একটি নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০২২ সালে মিশরের ‘শারম আল শেখ’-এ অনুষ্ঠিত কপ-২৭-এ একটি আইনি কাঠামোর আওতায় ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠনে সম্মত হয় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ সম্মেলনে ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের রেজল্যুশন গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে এবং তহবিলে বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি এসেছে। পরিবেশবাদীদের দৃষ্টিতে একটি দীর্ঘ লড়াই শেষে এ তহবিল গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার্থে একটি ক্ষীণ আশার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা পরিবেশগতভাবে নাজুক দেশগুলোর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কিঞ্চিৎ সহায়তা করবে।
ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের প্রস্তাবনার সময় প্রত্যাশা করা হয়েছিল জলবায়ুর বিরূপ আচরণের কারণে যেসব দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তাদের ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে পুষিয়ে দিতে এ তহবিলের ব্যবহার করা হবে।
উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে উপকূলবর্তী জনপদ প্লাবিত হয়ে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। অনেকের জীবিকা ও পেশার পরিবর্তন হতে পারে। বনভূমি ধ্বংস হতে পারে। পশু-পাখির আবাসস্থল পরিবর্তন হয়ে ইকোসিস্টেমের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। আবার ঘন ঘন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের কারণে জনপদের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এতদিন ধরে এসব ক্ষতির প্রতিকারের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক কর্মসূচি ছিল না। এখন থেকে এসব ক্ষতির তাৎক্ষণিক উপশম হিসেবে দুর্যোগ ঝুঁকিসম্পন্ন দেশগুলোর জন্য ক্ষয়ক্ষতি তহবিল আশার আলো হিসেবে কাজ করবে। বলা যায় এ তহবিল অভিযোজন বা প্রশমনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দিকে মনোযোগী হবে। সমস্যা হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠিত হলেও এর গঠন কাঠামো এবং তহবিল গঠন প্রক্রিয়া এখনো সুনির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ এ তহবিলে কারা অর্থ প্রদান করবে, কারা তহবিল পাওয়ার যোগ্য হবে এবং তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের শর্ত পূরণ করতে হবে—সেসব সুস্পষ্ট নয়। তহবিলে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর অনুদান ও প্রশ্নবিদ্ধ অঙ্গীকার সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতি বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষতি পোষাতে ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠন একটি উল্লেখযোগ্য
অগ্রগতি বলতেই হবে। কিন্তু এ তহবিল গঠন করা হবে কি হবে না, বিপন্ন দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কি হবে না—এ আলোচনা করতে যে ৩২ বছর নিষ্ফলা কাটিয়ে দেওয়া হলো; সেই ৩২ বছরে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ কে দেবে সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। বলাবাহুল্য, এই ৩২ বছরে বিশ্বের দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক আচরণ যেমন সাইক্লোন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, হিটওয়েভ, তুষারঝড়, দাবানল, সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমবাহের বরফ গলনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ২৪ অক্টোবর ২০২২-এ প্রকাশিত ইউরোস্ট্যাটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে ইইউতে ১৪৫ বিলিয়ন ইউরোর বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। আর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের মূলধন ও জিডিপির সম্মিলিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ২০২৩ সালের জিডিপির অর্ধেক। ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের ২৩ মে ২০২৩-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চরম আবহাওয়ার কারণে গত ৫০ বছরে বিশ্বে দুই মিলিয়নের বেশি মৃত্যু হয়েছে। এশিয়ায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা দেখা গেছে, এ সংখ্যা প্রায় এক মিলিয়নের বেশি। যার আবার অর্ধেকের বেশি শুধু বাংলাদেশেই মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ অর্থের নিরিখে পরিমাপযোগ্য না হলেও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে এ পরিসংখ্যান যথেষ্ট। ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২১-এর প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ুগতভাবে বিপন্ন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। অথচ মাত্র দশমিক ০.৫৬ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে বাংলাদেশ। নিম্নতম নিঃসরণের হার নিয়ে বাংলাদেশ উচ্চতম ঝুঁকিসম্পন্ন বিপন্ন দেশগুলোর তালিকায় অবস্থান করছে। এ দায় অবশ্যই উন্নত শীর্ষ নির্গমনকারী দেশগুলোকে নিতে হবে।
বাংলাদেশের মতো দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ অনুন্নত দেশগুলোর এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে ক্ষতিবিষয়ক গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। ক্ষয়ক্ষতির বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের দাবির পক্ষে সরব থাকতে হবে এবং দরকষাকষির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই হয়তো আইলা, সিডর, আম্পান, মোচার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি এবং নদী ও উপকূলীয় ভাঙনের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ক্ষতিপূরণের তহবিল আদায় করা যাবে। নইলে এ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেন—‘ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে, নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে।’
লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া