ইরান বিশাল দেশ। ১৭ লাখ বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১১ গুণ বড়। ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব-আজারবাইজানের খোদা আফারিন অঞ্চলের জোলফা নামের একটি স্থানে গিয়েছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে। এই পূর্ব-আজারবাইজান প্রদেশটি মধ্য এশিয়ার দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে লাগোয়া। ইরানের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রসিদ্ধ তাবরিজ শহর এ প্রদেশের রাজধানী। প্রেসিডেন্ট রাইসির এ যাত্রায় তিনটি হেলিকপ্টারের বহর ছিল। দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে তাবরিজ শহরে ফিরলেও প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। ভাষার অনেক ব্যবহার কৌশল আছে, যা মুখে একরকম আর উপলব্ধিতে আরেকরকম নাড়া দেয়। ইরানের সংবাদ সংস্থাগুলো এ দুর্ঘটনাকে ‘হার্ড ল্যান্ডিং’ বলে অভিহিত করেছে।
সর্বশেষ সোমবার সকালে কোথায় দুর্ঘটনা ঘটেছে তা খুঁজে বের করেছে ইরানের উদ্ধারকারীরা। এ লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত যে সংবাদ পাওয়া গেছে, তাতে জানা যায়, হেলিকপ্টারটি পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে এবং জীবিত কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ রাইসিসহ হেলিকপ্টারে থাকা নয়জনই নিহত হয়েছেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদুল্লাহিয়ান, তাবরিজের শুক্রবারের প্রার্থনার নেতা আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি আল-ই-হাশেম, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালেক রাহমাতি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইরানের উদ্ধারকারী রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, কারও মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ড্রোন ফুটেজ থেকে হেলিকপ্টারের লেজের একটি অংশ মাত্র দেখা গেছে। অনেক অনিশ্চয়তার পর সোমবার সকালে ইরানের বার্তা সংস্থা জানিয়েছে প্রেসিডেন্টসহ নয়জন নিহত হওয়ার কথা।
এ দুর্ঘটনা এমন একসময় ঘটল, যখন ইরান একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরাসরি না হলেও ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিদের যুদ্ধে সরাসরি ইসরায়েলের বিপক্ষে সহায়তাদানকারী দেশ ইরান। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের প্রধান বিচারপতি। নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছেন রক্ষণশীল পপুলার ফ্রন্ট অব ইসলামিক রেভল্যুশন ফোর্সের প্রার্থী হিসেবে। ৬৪ বছর বয়সী রাইসি বর্তমান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। ইরানে ধারণা ছিল, আলি খামেনির পর তিনিই হবেন প্রধান ধর্মীয় নেতা। ফলে ইরানের এ দুর্ঘটনা হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে—‘চুন খেয়ে গাল পুড়েছে, দই দেখলে ভয় করে’। চুন আর দই দেখতে একইরকম। অর্থাৎ চুন খেয়ে একবার যার গাল পোড়ে তার দই দেখলে ওই চুনের কথাই মনে পড়ে। যখনই প্রথম দুর্ঘটনাটির খবর প্রকাশ পায়, তখনই বিশ্বব্যাপী সবার মনে একটি সন্দেহ উঠে আসে, এটি কি শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা? কারণ ইব্রাহিম রাইসিকে একজন কট্টরপন্থি ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট যে হেলিকপ্টারে ছিলেন, সেটি আমেরিকার তৈরি বেল ২১২ ধরনের হেলিকপ্টার। এটি যথেষ্ট পুরোনো মডেল। ১৯৬৮ সালে এই হেলিকপ্টার যাত্রা শুরু করে এবং ইরান সত্তরের দশক থেকে এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, হেলিকপ্টারের ব্লেড জমে গিয়েছিল। তখন ওই অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রায় সাধারণত ব্লেড জমার কথা নয়। ইরান পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে হেলিকপ্টারে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ইরানের কাছে অসংখ্য আধুনিক সুপার কোবরা, চিনুক এবং বেল ১৪-এ রয়েছে। প্রেসিডেন্টের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাও আবার এই সময় কেন পুরোনো বেল ২১২ ব্যবহার করলেন বা তাকে চড়ানো হলো তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। যারা মোসাদের মতো, সিআইএ’র মতো গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনের ধরন সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, তারা জানেন কতরকম পদ্ধতিতে, কত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তারা কার্যোদ্ধার করে। বিশেষ করে কাজটি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা, অথবা সিআইএ’র যে কারও হতে পারে। এর পেছনে মোটিভ হিসেবে আরও একটি বিষয় দেখা যেতে পারে। সম্প্রতি ইরান ও আজারবাইজানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। চীন এ দুটি দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং করছে। রাজনৈতিকভাবেও দেশ দুটি চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। সুতরাং এখনই এক কথায় বলে দেওয়া যাবে না যে, এটি স্রেফ দুর্ঘটনা।
আবার সেটা নাও হতে পারে। হয়তো স্রেফ দুর্ঘটনাই। কারণ, প্রতিটি হত্যা বলি বা নাশকতা বলি তার পেছনে কিছু মোটিভ থাকে। সেদিক দিয়ে ব্যক্তি রাইসিকে হত্যা করা হলে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি লাভ দেখা যায় না। কারণ ইরানের নিয়মানুসারে দেশটির প্রেসিডেন্ট নীতিনির্ধারক নন, তিনি নীতি বাস্তবায়নকারী। ইরানের সর্বময় ক্ষমতা সুপ্রিম ধর্মীয় নেতা আলি খামেনির হাতে। রাইসি নিহত হওয়ায় ইরানের সংবিধানের ১৩১ আর্টিকেল অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব এখন গ্রহণ করবেন তারই ডেপুটি, অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার। তিনিও আলি খামেনির প্রিয়ভাজন এবং অত্যন্ত কট্টরপন্থি। ৬৯ বছর বয়সী মোখবার ছিলেন রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের একজন কর্মকর্তা। আয়াতুল্লাহ খামেনি তাকে ‘সেতাদ বা এক্সিকিউশন অব ইমাম খোমেনিস অর্ডার’-এর প্রধান করেছিলেন। মোখবারের ওপর পরমাণু অস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরির অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে ২০১০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট সেতাদ এক্সিকিউশন অর্ডারসহ ইরানের ৩৭টি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু এটি পরিষ্কার যে, সুপ্রিম লিডার যাকে পছন্দ করবেন, তিনিই হয়তো ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবেন।
ইরানের এ ঘটনার তদন্ত হবে। সে তদন্ত নিশ্চয়ই আমাদের দেশের তদন্ত কমিটির মতো না। অল্প সময়ে নিখুঁত এবং স্বচ্ছ তদন্ত হবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে। যদি সে তদন্তে কোনো নাশকতার আলামত পাওয়া যায়, তাহলে ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হবে? এক হতে পারে ইরান চুপ করে তদন্ত রিপোর্ট ঢেকে ফেলতে পারে। কারণ প্রেসিডেন্টকে হত্যার প্রতিশোধের দায় বর্তায়। সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে। আবার ইরান সমর ডঙ্কাও বাজিয়ে বসতে পারে। তৃতীয় আরেকটি অপশন হলো, ইরান হিজবুল্লাহ ও হুতি গেরিলাদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি এবং ইসরায়েলে হামলা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে পারে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ইরানের আল-কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাশেম সোলায়মানিকে বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। গত এপ্রিল মাসে সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়ে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এ দুটি ঘটনার পরই ইরান প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং জাহেদির হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইরান সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েলের ওপর।
নিঃসন্দেহে রাইসির মৃত্যু ইরানের জন্য একটি বড় ঘটনা। তবে আমরা এখনো জানি না, এটি হত্যাকাণ্ড কি না। হয়তো হত্যাকাণ্ড নয়। যদি হয়েও থাকে, তা হয়তো আমাদের আপাতত জানা হবে না। হয়তো কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তা অবসর গ্রহণ করে অনেক পরে কীভাবে হত্যা পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা স্মৃতিচারণ করে প্রকাশ করবেন। যেমনটি করেছেন ভিক্টর অস্ত্রভস্কি তার ওয়ে অব ডিসেপশন গ্রন্থে। যদি এটি হত্যাকাণ্ড না হয়ে থাকে, তাহলেও অনেক ইরানি এবং অন্যদের মনে সন্দেহ থেকে যাবে।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ইমেইল: [email protected]