বিদেশ সফরে গেলে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলন করে সফরের বিস্তারিত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি একটি রেওয়াজে পরিণত করেছেন তিনি এবং এ সংবাদ সম্মেলনে তিনি সফরের বিস্তারিত ছাড়াও দেশের সব ইস্যু নিয়েই সাংবাদিকদের প্রশ্ন গ্রহণ করেন ও উত্তর দেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে মঙ্গলবার যে সংবাদ সম্মেলন করেন তাতে অনেক বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেভাবে প্রশ্ন না থাকলেও তিনি অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের নিয়ে কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু মানুষ লোভী হয়ে যায়। টাকা-পয়সার লোভ এত বেড়ে যায় যে, দেশ বাদ দিয়ে বিদেশে রাখতে গিয়ে পরে দেশ থেকে ভাগতে হয়। সেই অর্থ বানিয়ে লাভটা কী হলো। এতই অর্থ বানিয়ে ফেলল যে, শেষে আর দেশেই থাকা যায় না। তাহলে লাভ হয় কী? এটা তো মানুষ চিন্তা করে না। টাকা বানানো (তাদের) নেশার মতো পেয়ে যায় মনে হয়। এটা হলো বাস্তব কথা।
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া আর কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির আলাপ যখন দেশব্যাপী তখন প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রমাণ করে সরকারপ্রধান বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত আছেন, তিনি কিছুটা হলেও বিরক্ত এবং তাদের প্রতি তার একটি ঘৃণাও আছে।
বেনজীর আর মতিউর আলোচনায় আছেন, তবে আরও অনেক কর্মকর্তার কথাও শোনা যাচ্ছে, কিছু কিছু রিপোর্টও আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে—এসব কর্মকর্তা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে নগদ অর্থ, জমি, বাড়ি, অসংখ্য ফ্ল্যাটসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অস্বাভাবিক সম্পদ করেছেন। সরকারি চাকরিজীবীদের অবৈধ সম্পদ ও অর্থ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনেই তার বিধান আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এরকম কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হওয়ায় বেনজীর বা মতিউরও সাজা পাবেন কি না, তা নিয়ে জনপরিসরে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বেনজীর আহমেদ যে দুর্নীতি করেছেন তার প্রমাণ তিনি নিজেই দিয়েছেন। গণমাধ্যমে অভিযোগ আসার পরপরই তিনি সপরিবারে বিদেশে পালিয়েছেন, সাহস নিয়ে দুদকের ডাকে সাড়া দেননি। আর মতিউর এতটাই দুর্বিনীত যে, নিজের সন্তানকেই তিনি অস্বীকার করেছেন অভিযোগ থেকে বাঁচতে। তিনিও পালিয়েছেন বলে খবর দেখা যাচ্ছে।
এসব সরকারি কর্মকর্তার বিপুল সব সম্পদের বিবরণী পড়তে গিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, একজন মানুষের বা একটা পরিবারের কত টাকা লাগে? কত জমাজমি দরকার হয়? সরকারি দায়িত্বে থেকে ক্ষমতা অপব্যবহার করে অর্থ আয়েরও তো একটা সীমা থাকা দরকার? এ ব্যক্তিরা যা করেছেন তা অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে গেছে। ক্ষমতা আছে বলেই কি যা খুশি তাই করা যায়? অন্যের জমি পছন্দ হয়েছে, বাড়ি পছন্দ হয়েছে, দিগন্তজোড়া মাঠ পছন্দ হয়েছে; ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সবকিছুই নিজের করে নেওয়া যায়? দুঃখজনক হলো তারা ভয়ংকর দুর্নীতিবাজ এবং একই সঙ্গে চরম রুচিহীন ও অশ্লীল মানুষ। জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে মানুষ অর্থ উপার্জনের দিকে মনোযোগ দেয়। জীবনের জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য অর্থের দরকার। এ প্রয়োজন মেটানোর পর ভোগবিলাস ও শখ, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্যও অর্থের দরকার হয়। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা এখন যে বেতন আর সুবিধা পান, তা আমেরিকা বা ইউরোপের সরকারি লোকজনও পায় না। অথচ তারা এরপরও দুর্নীতি করে এবং অতি নগ্ন হয়ে করে।
বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে উন্নয়ন কথাটি উচ্চারিত। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের এই ১৬ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বড় আলোচনার বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বেশি উঠে আসছে দুর্নীতির কথা। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প, সরকারি কেনাকাটা থেকে দুর্নীতি, ঘুষ, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, দখল—এমন কোনো দুর্নীতি নেই যা বাড়ছে না। একই সময়ে এত প্রকার দুর্নীতি আগে কখনো হয়েছে কি না, জানা নেই। তাই এখন প্রশ্ন জেগেছে, কোনটি আসলে এগিয়ে আছে—উন্নয়ন না দুর্নীতি?
একটু পেছনে যাওয়া যাক। ২০১৭ সালে তখনকার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের কাছে সে সময়ের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ একটি সরকারি পত্র পাঠিয়েছিলেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যোগ হতে পারছে না। বলা হয়েছিল এই হিসাব অবশ্য রক্ষণশীলভাবে করা। জিডিপির চলতি মূল্যকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
তখনই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে এখন কতটা ভয়াবহ এই চিত্র? সরকারি কেনাকেটা, জনবল নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দুদক চেয়ারম্যানের সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্নীতি রোধ করা গেলে প্রতি বছর দেশের জিডিপি ২ শতাংশ বাড়বে।’ ২০১৫ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আরও ১ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। তখনই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচার ইত্যাদি—রাষ্ট্রের এমন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থের দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ জিডিপির আড়াই শতাংশের মতো। সেই গবেষণা দেখিয়েছিল, রাষ্ট্রের বড় বড় ক্রয় খাতে যোগসাজশের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, এর পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে দুর্নীতির পরিমাণ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি বলে টিআইবি হিসাব দিয়েছে।
সে কারণেই বলা হয়, দুর্নীতি একটি মৌলিক উন্নয়ন সমস্যা। একদিকে দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, প্রবৃদ্ধি থামিয়ে দেয়, দরিদ্র ও দুর্বলতমদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। মানুষের আয় হ্রাস পাওয়া, ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ন্যায়বিচারসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হওয়ার বড় কারণ এই দুর্নীতি।
দুর্নীতি ও সামাজিক রীতির মধ্যে একটি দুষ্টচক্র কাজ করে। দুর্নীতিকে যদি প্রাথমিক স্তরেই আটকে না ফেলা যায়, যদি তা ব্যাপক হয়ে ওঠে, তখন তা সামাজিক রীতি বা নীতিতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের দেশে সেটাই ঘটেছে। দুর্নীতিই হয়ে উঠেছে কর্ম সংস্কৃতি। দেশের সুশৃঙ্খল সামাজিক নিয়ম বা রীতি, যা হয়তোবা দেশের কড়া আইন ও তার যথোপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শাস্তি পাওয়ার ভয় না থাকলেও মানুষকে দুর্নীতিমূলক কাজ থেকে বিরত রাখে। সমস্যা হলো, বেনজীরের মতো কর্মকর্তারা নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক মনে করেন, তারা নিজেদের মতো করে আইনের তোয়াক্কা না করে চলেন এবং সেভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে চাঁদা তোলেন, ঘুষ খান, দখলবাজি করেন।
এর পরিণাম হচ্ছে ভয়াবহ। আমাদের মতো গরিব দেশে দুর্নীতির এ ব্যাপকতা চড়া আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এতে করে জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা-পরিষেবা দেওয়ার মতো সম্পদের অভাব তৈরি হচ্ছে। আজ যে ব্যাংকগুলো ধুঁকছে তার কারণ কিছু মানুষের ব্যাংক দখল ও মানুষের আমানত আত্মসাৎ করা। দুর্নীতিবাজরা নিজেরাই যখন ক্ষমতার কেন্দ্র দখল করে থাকে তখন অনিয়ম, দুর্নীতি আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতি সামাজিক অনুমোদনের পথ তৈরি হয়। এমন একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে যে, দুর্নীতিবাজরাই সমাজে সমাদৃত হয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের, রাজনীতিকদের, কিছু ব্যাংক দখলবাজ ব্যবসায়ীর ব্যাপক দুর্নীতির যে চিত্র মিলছে, সামাজিক স্তরে তাকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ বলে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে দুর্নীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সামাজিক রীতির দুষ্টচক্রের মধ্যেই আমাদের সাঁতার কাটতে হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল