প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগে আম্পায়ারিং করেছেন মাসুদুর রহমান মুকুল। সাফল্যের সঙ্গে টুর্নামেন্টের ফাইনালের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। কয়েকদিন পর এশিয়া কাপেও বাংলাদেশের প্রতিনিধি হচ্ছেন তিনি। সেখান থেকে যাবেন আবার চীনে হওয়া এশিয়ান গেমসে। আম্পায়ারিংয়ের পরিবর্তনের হাওয়া ও চ্যালেঞ্জের গল্প শোনালেন কালবেলাকে; সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওমর ফারুক-
প্রশ্ন: কানাডায় সুযোগ এলো কীভাবে?
মুকুল: আফগানিস্তান সিরিজের সময় হঠাৎ আইসিসি থেকে জানতে চাওয়া হলো, আমি কি এ সময় ফ্রি থাকব? তখন বোর্ডের সঙ্গে আলাপ করি। তারা বলছে, ‘তখন আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা নেই। আমারও কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নেই।’ তারপর গ্লোবাল টি-টোয়েন্টির জেনারেল ম্যানেজার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুপক্ষের মধ্যে কথাবার্তা ফাইনাল করে সেখানে যাই। তার আগেই গাজী সোহেল শ্রীলঙ্কান প্রিমিয়ার লিগে ডাক পেয়েছিল। কিন্তু যখন আগে গেলাম (পরে সুযোগ পেয়েও আগে); তখন গাজীকে মজা করে বললাম, ‘গাজী তুমি আগে নিশ্চিত হলেও আমি কিন্তু প্রথম আম্পায়ার যে বাইরে কোনো লিগ করতে যাচ্ছি।’ তারা সবাই খুশি। আমাদের বন্ধনটা খুবই ভালো; একজন আরেকজনের সাফল্যে অনেক খুশি হই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বাংলাদেশের আম্পায়ারদের জন্য একটা দরজা খুলল। এখন এটা ধরে রাখতে হবে।
প্রশ্ন: দেশের বাইরে আম্পায়ারদের ইমেজ পরিবর্তন?
মুকুল: আমাদের ব্যাপারে একটু ভুল ধারণা ছিল আইসিসির—আমরা স্ট্রং; নিয়ন্ত্রণ আর সমন্বয়ক্ষমতা আমাদের কম; কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য দেশের চেয়ে ভালো বলে জানত। দ্বিতীয়ত, ঘরোয়া টুর্নামেন্টে আমরা অনেক বিতর্কিত। সবকিছু মিলিয়ে আইসিসি ও বিশ্বে ইমেজ খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু কভিডের সময় হোম সিরিজগুলো যখন হোম আম্পায়াররা করতে শুরু করল। তখনই ইমেজ বদলাতে শুরু করে। আমরা বড় বড় দলের সঙ্গে যে কয়টা সিরিজ করছিলাম, আইসিসি রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বে এক নম্বরে ছিলাম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে (৯৭ শতাংশ)। আইসিসি দেখল আমরা ম্যাচগুলো সফলভাবে শেষ করছি। ছোট ছোট নিয়মগুলো নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করছি। সৈকত দুর্দান্তভাবে টেস্ট ম্যাচগুলোর দায়িত্ব পালন করল। আমরা এশিয়া কাপে গিয়েও সফল হলাম। সবকিছু মিলিয়ে ইমেজে পরিবর্তন আসে।
প্রশ্ন: ফ্র্যাঞ্চাইজিতে প্রথম আম্পায়ার হওয়ার অনুভূতি?
মুকুল: অনুভূতি তো অন্যরকম। এশিয়া কাপের ফাইনাল করা একমাত্র বাংলাদেশি, এটাও ভেতরে ভেতরে গর্বিত করে। যখন ক্রিকেট খেলতাম, স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলা; যে কোনো পর্যায়েই হোক। কিন্তু আমার যোগ্যতা হয়নি কখনো বাংলাদেশ দলের লগো লাগানো। আম্পায়ারিংয়ে আসার পর সেটা হয়েছে। এই যে কানাডার টুর্নামেন্টের ফাইনালের পুরস্কার বিতরণীতে যখন সবাইকে মঞ্চে ডাকা হলো, তখন লিটন দাসকে তার দল সারে জাগুয়ারের নাম ধরে ডেকেছে। কিন্তু আমাকে যখন ডেকেছে তখন বলল, ‘মাসুদুর রহমান মুকুল ফ্রম বাংলাদেশ।’ ওই মুহূর্তের অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারব না। আমি এখনো ওই শব্দটা ফিল করছি। আপনি আমাকে পছন্দ না করলেও প্রথম বলতে গেলে হয়তো আমার নামই আসবে।
প্রশ্ন: আম্পায়ারদের মধ্যে বন্ধন?
মুকুল: আমরা কখনো আই বলি না, উই বলি। যেদিন থেকে এভাবে বলতে শুরু করছি, সেদিন থেকেই পারফরম্যান্স বাড়তে শুরু করছে। আমরা স্বপ্ন দেখি বিশ্বকাপ করব, এলিট প্যানেলে যাব। আগে আমি দেখতাম, এখন দেখি আমরা। একটা সময় টেস্ট ম্যাচ করার স্বপ্ন ছিল; সেটা পূরণ হলো। এখন একজন যদি ওয়ানডে বিশ্বকাপ করে, তাহলে এ দরজাটাও খোলা হয়ে যাবে। আমরা জুনিয়রদের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো সবসময় ভাগাভাগি করি। এতে তারাও অনেক কিছু বুঝতে পারে।
প্রশ্ন: সুযোগ মিলছে, চ্যালেঞ্জও কি বাড়ছে?
মুকুল: অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। অনেক ম্যাচে আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষিপ্ত মনোভাব দেখিয়েছি, সফলও হয়েছি। আমরা এখন যে জায়গায় আছি, এখান থেকে নিচে নামার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা যতদূর যেতে পারি ততটুক সাফল্য, পরের জেনারেশনের জন্য পথ তৈরি করতে হবে। তারা যেন বলতে পারে, তাদের ভালো জায়গা নিয়ে আসছি। আমাদের এখন পারফরম্যান্স ধরে রেখে আরও উন্নতি করতে হবে। আরও বড় বড় বাইরের সিরিজ-টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যোগ্যতা বৃদ্ধি করা—এসব চ্যালেঞ্জ থাকবে।
প্রশ্ন: কোন অনুপ্রেরণা থেকে আম্পায়ারিংয়ে পেশায়?
মুকুল: আমার একটা অভ্যাস আছে, যখন যে অবস্থায় থাকি; তার ওপরের কিছু করি না। জাতীয় দলে খেলা আমার বন্ধু নাইমুর রহমান দুর্জয়, মেহরাব হোসেন অপি, নিয়ামুর রশিদ রাহুল, মোর্শেদ আলী খান সুমন ছিল। কিন্তু আমি কখনো বলতাম না, তোর টি-শার্টটা দে বা ক্যাপটা দে। কিন্তু যখন আম্পায়ারিং করার সময় টি-শার্টে বাংলাদেশের পতাকা দেখলাম। তখন ভাবলাম এত কিছু করেও যেটা পেলাম না, শুধু আম্পায়ারিংয়ে এসেই সেটা পেলাম। তখনই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করি যে, এ পেশায় আসব। তবে শুরুর দিকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। বোর্ডের চুক্তিতে ঢোকার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়।
প্রশ্ন: মানুষের নেতিবাচক মন্তব্য?
মুকুল: আমার প্রিয় দল রিয়াল মাদ্রিদের যখন খেলা দেখি, রেফারি ভুল সিদ্ধান্ত দিলে আমিও বকা দিই। আমি আম্পায়ার হয়ে যদি দিতে পারি, তাহলে যে দর্শক দলকে ধারণ করে, সে কেন দেবে না। আমি নিজেকে ওভাবেই তৈরি করে নিয়েছি, বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের বিপক্ষে ভুল সিদ্ধান্ত দিলে আমাকেও বকা খেতে হবে।
মন্তব্য করুন