আশপাশে কী ঘটছে—দেখছেন, কে কী বলছেন—শুনছেন। সারল্যমাখা সুরে মোবাইল ফোনে কথাও বলছেন। কিন্তু মোহাম্মদ লিটনের কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে! ফুটবলার মোছাম্মদ সাগরিকার বাবার জীবনের চিত্রনাট্য যেভাবে বাঁক নিয়েছে, তা তো স্বপ্নের মতোই লাগার কথা!
একসময় যারা মেয়ের বখে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে নেতিবাচক কথায় কান ভারি করতেন, তারাও ইউটার্ন নিয়েছেন, বদলেছেন সুর। মেয়ের খেলা দেখতে ঢাকা এসে সবার কাছে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেন; জীবিকার একমাত্র মাধ্যম চায়ের দোকানে বসে সেটা স্বপ্নে দেখাও ছিল দুঃসাধ্য! শুক্রবার খেলা শেষ করে গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরতে বাসে টিকিট পাননি। গত রাত পর্যন্ত মিরপুর ১২ নম্বরে খালাশাশুড়ির বাসায় ছিলেন। গত রাতেই ফেরার কথা ছিল লিটন দম্পতির। ফিরলে যে বীরোচিত অভ্যর্থনা পাবেন—গতকাল ঢাকায় বসে তা আঁচ করতে পারছিলেন, ‘আমার বাড়িতে বড় পর্দায় খেলা দেখেছেন কয়েক হাজার মানুষ। খেলা দেখার পর থেকে সবাই প্রতীক্ষায় আছেন। ঘনিষ্ঠরা জানতে চাচ্ছেন কখন ফিরব, সাগরিকাকে নিয়ে আসছি কি না।’
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনামে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডের পর সর্বশেষ বাড়ি গিয়েছিলেন সাগরিকা। পরেরবার যখন যাবেন, তখন নিশ্চয়ই চিত্রটা অতীতের মতো থাকবে না। থাকার কথাও নয়। সদ্য সমাপ্ত আসরে তিন ম্যাচে ৪ গোল করেছেন। যার দুটি ভারতের বিপক্ষে। দুটি গোলই ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে। প্রাথমিক পর্বের গোলটা ছিল জয়সূচক। ফাইনালে দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলেন। হারতে বসা ম্যাচ টাইব্রেকারে টেনে নিয়েছেন। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হওয়ার পর গোটা দেশই সাগরিকায় মজেছে। এ ফুটবলারের ফেরার প্রতীক্ষায় থাকার কথা তো গোটা ঠাকুরগাঁওয়ের, গোটা রানীশংকৈলের!
যাকে নিয়ে আলোচনা, সে সাগরিকাকে নিয়ে কিন্তু ক্ষোভ-অভিমানের গল্পও আছে। ২০২১-২২ মৌসুমে নারী লিগ দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করেন এ ফুটবলার। ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি থেকে এ ফুটবলারকে তুলে আনে এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ক্লাবটির কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন জুবায়ের সম্প্রতি ফেসবুকে ক্ষোভ নিংড়ে দিলেন এভাবে, ‘সাগরিকাদের যারা তৈরি করেন এবং বড় পরিসরে তুলে আনার কাজ করেন, তাদের কেউ কখনো মূল্যায়ন করতে চায় না! তবুও এগিয়ে যাক সাগরিকা, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।’
ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলামের হাতে গড়া আলোচিত এ ফুটবলার। কেবল সাগরিকা নয়, সদ্য সমাপ্ত আসরের আরেক আলোচিত ফুটবলার স্বপ্না রানীও এ কোচের আবিষ্কার। ২০২২ সালে নেপালে সাফ জয়ী দলের স্বপ্না রানীর সঙ্গে তাজুল ইসলামের আরেক ছাত্রী সোহাগী কিসকুও ছিলেন।
‘বর্তমান সিনিয়র ও বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলছেন আমার সাত ছাত্রী। এ পর্যন্ত বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলে খেলেছেন আমার ১৮ ছাত্রী। গত নারী লিগে আট দলে আমার ২২ ছাত্রী খেলেছে। তাদের পরিচর্যায় বছরে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়। সরকারি কিংবা বেসরকারি সহায়তা পেলে ভবিষ্যতে আরও সাগরিকা উপহার দিতে পারব আমি’—কালবেলাকে বলছিলেন সাগরিকার শৈশব গুরু তাজুল ইসলাম।