চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয় স্বর্ণসহ দামি সাত পণ্য। বিপরীতে ভারত থেকে অস্ত্র, মাদকসহ আট ধরনের ভেজাল পণ্য বাংলাদেশে আসে। এই চোরাচালানের কারণে অর্থ পাচারের পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধও বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীরা জড়িত। আর এই চোরা চালানে সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। চোরাচালান প্রতিরোধে সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।
গত ১৮ নভেম্বর ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত থেকে ৫ কেজি ৪৭৮ গ্রাম ওজনের ৪৬টি স্বর্ণের বারসহ দুজনকে আটক করেছে বিজিবি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। এই স্বর্ণের বারগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করা হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন মহেশপুর ব্যাটালিয়ন (৫৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহ মো. আজিজুস শহীদ।
এভাবে প্রতিদিনই দেশের সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের সময় বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী ধরা পড়ছে। বিজিবির তথ্যানুযায়ী, দেশের বিভিন্ন সীমান্তে গত নভেম্বরে ১৭২ কোটি ২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের পণ্যসামগ্রী চোরাচালানের জব্দ করেছে বিজিবি। জব্দ করা পণ্যের মধ্যে ৮ কেজি ৫৭০ গ্রাম স্বর্ণ ও ১৬ কেজি ৭৯৫ গ্রাম রুপা রয়েছে। এ ছাড়া শাড়ি, থ্রিপিস, শার্টপিস, চাদর, কম্বল, তৈরি পোশাক, থান কাপড়, কসমেটিক্স, ইমিটেশন সামগ্রী, কাঠ, চা পাতা, চিনি, সার, কয়লা, পাথর, বালু, মোবাইল ডিসপ্লে, চশমা, ফল, বাংলাদেশি রসুন, জিরা, কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো মালপত্র রয়েছে।
একই মাসে সীমান্ত থেকে ৬টি পিস্তল, ৮টি গান জাতীয় অস্ত্র, একটি রাইফেল, একটি রিভলবার, ৭টি ককটেল, ৪টি ম্যাগাজিন এবং ৪২১টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য, যার মধ্যে রয়েছে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬টি ইয়াবা, ১ কেজি ২৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ৬ কেজি ৭৩৭ গ্রাম হেরোইন, ২৩ হাজার ৪৪৯ বোতল ফেনসিডিল, ১ হাজার ৩০৯ কেজি গাঁজা, ২৩ বোতল এলএসডি।
বিজিবির তথ্য বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজিবি সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ৯২৫ কেজি ৯১৯ গ্রাম চোরাচালানের স্বর্ণ জব্দ করেছে। এসব স্বর্ণ ভারতে পাচারের জন্য বাংলাদেশ রুট ব্যবহার করা হচ্ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের এই চোরাচালানের বিষয়ে গত জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে বিজিবি। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে মূলত সাতটি দামি পণ্য ভারতে চোরাচালানের মাধ্যমে যায়। এর বিপরীতে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে অস্ত্র, মাদকসহ আটটি ভেজাল ও নকল পণ্য। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হওয়া সাতটি পণ্য হলো সার, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, তৈরি পোশাক, স্বর্ণ ও কষ্টিপাথর, বৈদেশিক মুদ্রা এবং সামুদ্রিক মাছ।
বিপরীতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে মাদকসহ আট ভেজাল পণ্য। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে আসে ইয়াবা ও আইস, যা আবার ভারত হয়েও দেশের পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে আসে। বিজিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসা পণ্যগুলো হলো মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্য, পোশাক, নিম্নমানের ওষুধ, নিম্নমানের মোটর যন্ত্রাংশ, নিম্নমানের কসমেটিক্স, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, জাল নোট, ইয়াবা (মিয়ানমার ও ভারত) এবং ক্রিস্টাল মেথ বা আইস (মিয়ানমার)।
কোন সীমান্ত দিয়ে কী পাচার হয় : দেশের অধিক চোরাচালানপ্রবণ এলাকার মধ্যে রামু, টেকনাফ, কক্সবাজার, রহনপুর ও ফুলবাড়ী এলাকা থেকে বাংলাদেশে আসে ইয়াবাসহ মাদক। মহেশপুর, চুয়াডাঙ্গা ও রহনপুর সীমান্ত থেকে আসে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। মহেশপুর, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ ও রুপা পাচার হয়। সুলতানপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ এবং নেত্রকোনা এলাকার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় ভোজ্য পণ্য ও গবাদি পশু।
এক বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণ ও হীরা পাচার : বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট জানিয়েছে, শুধু ২০২৩ সালে বাংলাদেশ হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ ও হীরা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার স্বর্ণ ও ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার হীরা রয়েছে। এই চোরাচালানের পুরো টাকাই হুন্ডির মাধ্যমে কারবারিরা বিদেশে পাচার করে।
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের চেয়ারম্যান রিপনুল হাসান বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০টি জেলার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের ছয় জেলা মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা হয়ে উঠেছে স্বর্ণ চোরাচালানের প্রধান রুট। ভারতে পাচার হওয়া স্বর্ণের বড় একটি অংশ এসব জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়।
তিনি বলেন, আমাদের প্রাথমিক ধারণা, প্রতিদিন সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ স্বর্ণালংকার, স্বর্ণের বার, ব্যবহৃত পুরোনো জুয়েলারি ও হীরার অলংকার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে।
বাজুস জানিয়েছে, গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, এসব স্বর্ণ বৈধপথে আমদানি করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমা হতো, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ হতো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
স্বর্ণ চোরাচালানের বড় রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এই চোরাচালান প্রতিহত করার জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যেসব পদক্ষেপ নেয় তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন রিপনুল হাসান। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বারবার সুপারিশ জানাই; কিন্তু সে লক্ষ্যে কার্যক্রম নেই। আকাশপথে স্বর্ণ আসছে, স্থলপথ দিয়ে চলে যাচ্ছে; কিন্তু এটা ঠেকানো যাচ্ছে না। দেশের প্রায় প্রতিটি সীমান্ত অঞ্চল দিয়েই স্বর্ণ পাচার হয়। কোনো সীমান্তে ধরা পড়ে, কোনোটাতে পড়ে না।