কয়েক মাস ধরে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলন, অবস্থান কর্মসূচিসহ নানা ধরনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখিয়ে এবার সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রধান ফটকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা ব্যানার টানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা কমিটির কার্যক্রম দৃশ্যমান না হওয়ায় নিজেদের উদ্যোগে তারা এ ব্যানার টানান। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি বাস্তবায়নের আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেছেন তারা।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজকে ‘আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়’ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নামেন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। কিন্তু অক্টোবরে সরকারি তিতুমীর কলেজের একদল শিক্ষার্থী তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে আলাদা কর্মসূচি শুরু করে। তাদের আন্দোলনের মুখে এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা সম্ভব কি না, তা যাচাইয়ে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানে কমিটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ না নেওয়ায় নিজেদের উদ্যোগে গত মঙ্গলবার কলেজের প্রধান ফটকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানার টানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
তবে শিক্ষাবিদরা বলেছেন, কলেজের ফটকে বিশ্ববিদ্যালয় লেখা ব্যানার টানিয়ে দিলেই সেটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় না। কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত অবকাঠামো, যোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষকসহ অনেক কিছুই নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর গত ২২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে সাত কলেজের সমন্বয়ে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। সে সময় তিতুমীর কলেজও একই দাবিতে আন্দোলন করে। তবে অক্টোবর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশ তাদের কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নামে। তাদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। তবে কোনো সমাধান হয়নি।
ফলে ১৮ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা মহাখালীর রেল সড়ক অবরোধ করেন। তবে এ সময় ট্রেনে ঢিল ছোড়া ও এক শিশুসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনায় সারা দেশেই সমালোচনার শিকার হন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এরপর ৩ ডিসেম্বর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা সম্ভব কি না, তা যাচাইয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক মনোনীত কমিশনের একজন সদস্যকে সভাপতি আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়) শাহীনুর ইসলামকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত একজন উপ-উপাচার্য এবং মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়-২ অধিশাখা) নুমেরী জামান।
এ কমিটির কার্যক্রম দৃশ্যমান না হলে গত মঙ্গলবার সকালে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে দুপুর সাড়ে ১২টায় মূল ফটকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানার টানিয়ে দেন তারা। এ নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুমেরী জামান কালবেলাকে বলেন, শিক্ষার্থীরা কেন এমনটি করল, তারাই ভালো বলতে পারবে।
এ বিষয়ে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী বেলাল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কথা বলা হলেও তা কার্যকরে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এই কলেজের শিক্ষার্থীরা তৎকালীন ‘জিন্নাহ কলেজ’ নাম ফলক ফেলে দিয়ে পরিবর্তন করেছিল ‘তিতুমীর কলেজ’ নামে। সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আজও (গতকাল) নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশীদ বলেন, সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট (ধারণা) আসলে কী, তা শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে যেখানে বিশ্বের নলেজ (জ্ঞান) দিতে হয়। সে ধরনের গবেষণা, শিক্ষক, সক্ষমতা, অবকাঠামো থাকতে হয়। জমি আর ছাত্র সংখ্যা বেশি হলেই সেটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে না। কলেজের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানার টানিয়ে দিলেই সেটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় করার চেয়ে কলেজের শিক্ষার মান বাড়ানো নিয়ে কাজ করা উচিত।
শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, আমরা একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। চার-পাঁচশ শিক্ষার্থী সচিবালয় আক্রমণ করে ১৪-১৫ লাখ শিক্ষার্থীর এইচএসসি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে এলো। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছে, দাবি জোরালো হলেই সেটি আদায় করা সম্ভব। এরই ধারাবাহিকতায় তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি উঠেছে। শিক্ষার্থীরাই এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘোষণা করলেই তো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে না। সনদের ওপর তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় লেখা থাকলেই শিক্ষার্থীরা পছন্দের কাজ পাবে না। তাদের আন্দোলনের চেয়ে জ্ঞান-দক্ষতার দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। আরও উচিত শিক্ষার মান নিয়ে আন্দোলন করা। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিতের দাবি তোলা উচিত। কলেজ মানসম্মত হলে শিক্ষার্থীদের মানও বাড়বে।