দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ৪ মে থেকে চার ধাপে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব নির্বাচনের তপশিল শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। এর আগে নওগাঁ-২ আসন, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা সিটিসহ কয়েকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইসি সূত্র জানায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ও আচরণ বিধিমালার ব্যাপক সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ২৫০ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা, নির্বাচনী পোস্টার, নির্বাচনী প্রচার এবং প্রার্থীদের জামানতসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড় ধরনের সংশোধন আনা হতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার নেতৃত্বাধীন ‘আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি’ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন পরিচালনা ও আচরণ বিধিমালা নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক করে যাচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় নির্বাচন ভবনের পঞ্চম তলার সম্মেলন কক্ষে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির প্রস্তুতকৃত খসড়া গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশনের ২৭তম সভায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালার সম্ভাব্য সংশোধনীর বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনাও হয়। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি উপজেলার দুটি বিধিমালা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সুপারিশ কমিশন সভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠাবে। এরপর কমিশন তা চূড়ান্ত করলে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নের সঙ্গে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারদের সমর্থন সূচক স্বাক্ষর জমাকে সংবিধান বিরোধী বলে মনে করছে ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি। এজন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিলকৃত ২৫০ জন ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা দাখিলের বিধান বাতিল করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব এসেছে। স্বাক্ষর বাতিলের যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত জামানতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে গোপন ভোটের আগেই সংবিধানবিরোধী উপায়ে কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থনদানের বিষয়টি বাতিল করা যেতে পারে।
২০১৬ সালে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট হওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমার ক্ষেত্রে ২৫০ জন ভোটারের স্বাক্ষর দেওয়ার বিধান চালু হয়। যদিও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমাদানের বিধান রয়েছে। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ১ শতাংশ বিধানকে সংবিধানবিরোধী অ্যাখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ দিতেই বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র আরও জানায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা-২০১৩ এর সংশোধনীতে ২৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬-তে সংশোধনীতে ৮টি সুপারিশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন বিধিমালা-২০১৩ এর অন্যতম প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে অনলাইন পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র দাখিল। বর্তমানে সরাসরি অথবা অনলাইন উভয় পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কেবল অনলাইন পদ্ধতিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান করা যেতে পারে। এ ছাড়া এবারই প্রথম ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারের সুযোগ পাচ্ছেন প্রার্থীরা। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা প্রতিপালন সাপেক্ষে প্রার্থীরা কিংবা তাদের নির্বাচনী এজেন্ট-সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ইমেইল আইডিসহ শনাক্তকরণ তথ্যাদি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে। একইভাবে প্রতীক বরাদ্দের আগেই নির্দিষ্টসংখ্যক লোকজন নিয়ে জনসংযোগ করতে পারবেন প্রার্থীরা।
এ ছাড়া সমান ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুনঃভোটের বিধানের পরিবর্তে লটারির মাধ্যমে চূড়ান্ত করার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। ব্যালট পেপারের মুড়িপত্রে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরের বিধান চালুর প্রস্তাবনা এসেছে। ভোট গ্রহণের আগে কোনো প্রার্থী মারা গেলে অবশিষ্ট একজন প্রার্থী থাকলে নির্বাচন বাতিল করে নতুন ভোটের কথা বলা হয়েছে। কমিটির প্রস্তাবনায় নির্বাচনের ফল স্থগিত এবং ফের ভোট গ্রহণের বিধান যুক্ত; আয়কর রিটার্ন দাখিল; নির্বাচনের তপশিল সংশোধন বা নতুন তপশিল ঘোষণার বিধান; একাধিক ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপাশি নির্বাচনী ক্যাম্পে টেলিভিশন ও ভিসিআর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার; কোনো প্রার্থী একাধিক পদে মনোনয়ন দাখিল না করতে পারার বিধান সংযুক্ত করা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাচনে ‘ভুঁইফোঁড়’ প্রার্থীর সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সেজন্য চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদের জামানত ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। জামানত বাজেয়াপ্তের বিধানেও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। নির্বাচনে যে সংখ্যক ভোট পড়বে, তার ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট না পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে জমার বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে প্রদত্ত ভোটের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান রয়েছে।
পোস্টারে পলিথিনের আবরণ এবং প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। নির্বাচনে শব্দদূষণ কমানোর লক্ষ্যে মাইকের সাউন্ড ৬০ ডেসিবলের নিচে রাখার বিধান যুক্তের জন্য বলা হয়েছে। নির্বাচন বিধিমালায় নির্বাচনী দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তি, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের হুমকি, ভীতি ও বাধা দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অনিয়ম ও প্রভাব বিস্তার হলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে বিধিতে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই।
নির্বাচন বিধিমালায় আরও যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—নির্বাচনী ব্যয়সীমা বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ; পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা এবং নির্বাচন প্রচার মনিটরিংয়ে কমিটি গঠন করা। উপজেলা নির্বাচনে রঙিন পোস্টার ও ব্যানার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘হয়তো সচিবালয় কোথাও থেকে ফিডব্যাক পেয়েছে, স্বাক্ষরের (২৫০ ভোটারের) বিষয়টা না রাখাই ভালো। আবার অনেকে বলছেন, না রাখলে সমস্যা হবে। এ বিষয়ে মিশ্র মতামত আছে। আমাদের কাছে এলে ভালোমন্দ দিক বিবেচনা করব। আলোচনা না করে কিছু বলতে পারব না।’