বৃহত্তর কুমিল্লার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক লালমাই পাহাড়। কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ ও বরুড়া উপজেলাজুড়ে এই পাহাড়টি অবস্থিত। এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১ মাইল লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২ মাইল চওড়া। এ পাহাড়ের মাটি লাল হওয়ায় এর নাম লালমাই। এর উচ্চতা ৫০ ফুট।
কথিত আছে, রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের ছোট ভাই লক্ষ্মণ গুরুতর আহত হলে বৈদ্য জানায়, বৈশল্যকরণী পাতার রস ক্ষতস্থানে লাগালে লক্ষ্মণ ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু হনুমান গাছ চিনতে না পেরে হিমালয় পর্বত পুরোটা তুলে নিয়ে আসে। চিকিৎসার পর আবার পর্বতটা যথাস্থানে রাখতে রওনা দেয় হনুমান। কিন্তু পথে পর্বতের কিছু অংশ ভেঙে কুমিল্লা সংলগ্ন লমলম সাগরে পড়ে। তখন থেকেই এ স্থানের নাম হয় লালমাই।
এমনও গল্প শোনা যায়, এক রাজার নাকি দুই মেয়ে ছিল। একজনের নাম ছিল লালমতি, অন্যজনের নাম ময়নামতি। তাদের নামানুসারেই এই লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। লালমাই পাহাড়ের লাল মাটি ছাড়াও রয়েছে পর্বতের উপরে কোথাও ঘন গাছপালা, কোথাও ফাঁকা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে শালবন বৌদ্ধবিহার। এ ছাড়া পাহাড়ের এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক স্থাপনা।
লালমাই পাহাড়ের একটি স্থানের নাম সালমানপুর। এখানে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। একই এলাকায় আছে সিসিএন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও। এখানেও রয়েছে শালবন বিহার। আগে এই প্রত্নস্থানটি ‘শালবন রাজাবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এর আসল নাম ‘ভবদেব মহাবিহার’। এই বিহারটি খনন করে পাওয়া গেছে বিপুলসংখ্যক প্রত্নসম্পদ, যা ময়নামতি জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। রয়েছে ময়নামতি বৌদ্ধবিহার। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে।
বৌদ্ধবিহার থেকে ৩ মাইল উত্তরে রয়েছে কুটিলা মুড়া ও রূপবান মুড়া। এরও উত্তর-পশ্চিমে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত চারপত্র মুড়া। এখানেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। বার্ডের ভেতরের নয়নাভিরাম রাস্তা দিয়ে সামনে এগোলেই দেখতে পাওয়া যাবে নীলাচল পাহাড়। দুই পাহাড়ের মাঝখানে দেখতে পাওয়া যায় অনিন্দ্যসুন্দর বনকুটির। চণ্ডী মন্দিরদ্বয়ও এখানে। আর এই চণ্ডী মন্দিরদ্বয়ের নামানুসারে এলাকাটি চণ্ডীমুড়া নামে পরিচিত।
লালমাইয়ের পাশেই রয়েছে নূরজাহান ইকো পার্ক, রাজেশপুর ফরেস্ট, শাহ সুজা বাদশাহ মসজিদ, রাজা ধর্মমাণিক্যের খননকৃত ২৩.১৮ একর আয়তনের ধর্মসাগর, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতবিজড়িত ময়নামতি ওয়ার সিমিট্রি, রানির বাংলো, ত্রিশ আউলিয়ার মাজার, নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি, পাশেই রয়েছে কুমিল্লার সুখ-দুঃখ গাঁথা গোমতী নদী। রয়েছে কুমিল্লা পৌর শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা ও ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।
১৯৮৯ সালের এপ্রিলে ও ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে লালমাই পাহাড়ে কয়েক দফা অনুসন্ধান কাজ হয়। এতে এখানে ১১টি প্রত্ন ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে লালমাই-১, লালমাই-২, লিলামুড়া, টক্কামুড়া, মহরম আলীর বাগি, টিপরা মুড়া, আদার মুড়া, মাইদার মুড়া, মেম্বোরের খিল, মেহের কুরের মুড়া, টক্কামুড়া-২।