দুলাল হোসেন
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৩, ০৭:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন

ডেঙ্গুর প্রকোপ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নগর-মহানগরে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এ চাপ নিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। এখন প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এটি সরকারি হিসাব। এর বাইরে থেকে যাচ্ছে বড় অংশের আক্রান্তের সংখ্যা। ডেঙ্গু রোগী এবং মৃতের সংখ্যার সরকারি হিসাব প্রকৃত চিত্র নয়। কারণ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার ২০টি সরকারি ও ৪৩টি বেসরকারিসহ মোট ৬৩টি হাসপাতালের তথ্য পেয়ে থাকে। এর বাইরে কয়েকশ হাসপাতাল রয়েছে। যেগুলোর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যাচ্ছে না।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণযোগ্য হলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ হচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের সক্ষমতা নেই, তারা পুরোপুরি অক্ষম। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সিটি করপোরেশনের কারিগরি ব্যবস্থা ও জনবল বাড়ানো, কীট পরীক্ষার ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং প্রতিটি জোনে কীটতত্ত্ববিদের নেতৃত্বে দল গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় ডেঙ্গু আগামীতে দেশের একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে থেকে যাবে বলে মনে করছেন তারা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন মহামারির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বলে মনে করছে প্রায় সব মহল। প্রথমে রাজধানীকেন্দ্রিক হলেও খুব দ্রুত বিস্তার ঘটিয়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে। ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর অক্ষমতা ও গাফিলতিতে বড় করে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রথমত এই সংকটের দায় ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের। ডেঙ্গুর মৌসুম এপ্রিল থেকে শুরু হলেও মশা নিধনে তাদের জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে মাঝেমধ্যে মশকনিধন কর্মীর দ্বারা ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারার যে চেষ্টা, তাতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তাতে মশা মরছে কি না, কোথায় ও কখন ইনসেকটিসাইড বা লার্ভিসাইড ওষুধ দিতে হবে; কোথায় মশা বাড়ছে, তার কোনো গবেষণা নেই। এ কাজগুলো সিটি করতে পারছে না। এসব কাজ আবার সাধারণ জনবল দিয়ে করলে হবে না, এর জন্য কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল ও যন্ত্রপাতি, যা সিটি করপোরেশনের নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে কারিগরি বিষয়গুলো থাকা দরকার, যে কারিগরি লোক দরকার, এখানে সেটা একেবারে অনুপস্থিত। এখানে কারিগরি লোক হচ্ছে কীটতত্ত্ববিদ। কিন্তু সিটি করপোরেশনগুলোতে সেটি অনুপস্থিত। তারা ভালো জানে এডিস মশা কোথায় বংশবিস্তার করে, তারা ভালো সার্ভে করতে পারে। এই সক্ষমতাটার আমাদের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের সিটি করপোরেশর কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই, কোনো কীটতত্ত্ব ল্যাবরেটরি নেই, কীটতত্ত্ব জরিপকারী নেই। তারা মূলত নির্ভর করে মশকনিধন কর্মীদের ওপর। তাদের যারা সুপারভাইজার, তারাও আবার নন-টেকনিক্যাল পারসন। সুতরাং তারা নিজেরাও বোঝে না কীভাবে মশা নিধন করতে হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কলকাতার সঙ্গে যেটা পার্থক্য হচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে কলকাতা প্রতিটি জোনে একটি কীটতত্ত্ব দল রেখেছে। ওই কীটতত্ত্ব দল সংশ্লিষ্ট জোনে সব সময় জরিপ করে এবং তাদের নেতৃত্বে ওখানে ইনসেকটিসাইড, লার্ভিসাইড ও অন্যান্য মেজার নেওয়া হয়। তারপর আবার জরিপ করে কাজটা কেমন হলো। যদি কাজ সন্তোষজনক না হয়, তাহলে তারা আবার ইন্টারভেশন নেয়। তারা মূলত ডেঙ্গু মৌসুমের তিন-চার মাস আগে থেকে নিশ্চিত করে এডিস মশা বেশি নেই, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আছে। এরপর তারা সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়। আমাদের এখানে এটা হচ্ছে না।

অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, আমরা মশক নিধন শুরু করছি, যখন ডেঙ্গু অনেক হচ্ছে। ততদিনে এডিস মশা বংশবিস্তার করে ফেলেছে এবং তারা অনেক ছড়িয়ে গেছে। তখন মেজারগুলো নিতে নিতে ডেঙ্গু রোগী বেশি হয়ে যাচ্ছে। বারবার এমন করতে করতে আমাদের এখানে এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এখন খুব কঠিন। কারণ, এডিস মশা যে ডিম পাড়ে, তা যে শুকালেই নষ্ট তা নয়, এই ডিম এক-দুই বছর পর্যন্ত ঠিক থাকে। এরপর যখনই বৃষ্টি হচ্ছে, ডিমগুলো পানি পাচ্ছে এবং তখনই ফুটে এডিস মশা তৈরি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের গাফিলতি রয়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না। কারণ, গাফিলতি হচ্ছে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা, কিন্তু করছে না। ঘটনা কিন্তু এটি নয়, সিটি করপোরেশনগুলো এডিস মশা মারতে পারছে না, এটি হচ্ছে তাদের অক্ষমতা। কারণ, তাদের এই কারিগরি জ্ঞান নেই, কারিগরি দল নেই, কারিগরি ল্যাবরেটরি নেই। সুতরাং এটি হচ্ছে এক ধরনের অক্ষমতা। যারা মশা মারতে সক্ষম নয়, তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, আমরা যেহেতু ঢাকার এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এটি গত ২৩ বছরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরে যে এডিস ছড়াল, এখন এটি নিয়ন্ত্রণ করা ঢাকা থেকেও কঠিন হবে। কারণ, সারা দেশে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা, ধ্বংস করা কঠিন একটি কাজ। তাই বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়েই অনেক বছর অবস্থান করবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ডেঙ্গু যে জিনিসগুলো দিয়ে প্রভাবিত হয় যেমন তাপমাত্রা, আদ্রতা ও নগরের ভৌত পরিবেশ। এ নগরের ভৌত পরিবেশ এমন হয়েছে, যেখানে সেখানে পানি জমে থাকছে, ময়লা-আবর্জনা জমা হচ্ছে, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না; ভবনগুলো এমন সংকীর্ণভাবে নির্মিত, যেখানে মশা জন্মানোর পরিবেশ আছে, অপরিকল্পতিভাবে ভবন নির্মাণের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। নগরের সামগ্রিক পরিকল্পনা ফেইল করেছে, ফলে মশা বাড়ছে। মশা বাড়ার কারণে তা নিধনের জন্য কীটতত্ত্ববিদের প্রয়োজনটা হয়েছে। এখন মশার যেহেতু বংশবিস্তার ঘটেছে, তা নিধনে কীটতত্ত্ববিদদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা যেন বংশবিস্তার করতে না পারে, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলেছে, গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৩৬১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে মারা গেছেন ১০ জন। গত ১ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ২৬ দিনে ৩৪ হাজার ৭২৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে মারা গেছেন ২২৫ জন। চলতি বছরের সাত মাসে ৪২ হাজার ৭০২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর বাইরে অনেক রোগী আছেন, যারা চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। যারা আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকে।

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোয় রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কোনো হাসপাতালে বিছানা খালি নেই। নির্ধারিত শয্যার বাইরেও মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ধারণক্ষমতার বাইরে রোগী ভর্তি করতে চাচ্ছে না। ফলে নতুন আক্রান্তদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে স্বজনদের। রোগীর অবস্থা জটিল না হলে তাদের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। কারণ, এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টি হয়ে থাকে। অতীত রেকর্ড বলছে, এডিস মশার বংশবিস্তার এ সময়ে বেশি হয়ে থাকে। ফলে আগামী দু-এক মাস ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার হতে পারে, যা জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে শতভাগ ঠিক পথে আছেন—এমন দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের ১১ জনের একটি কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ টিম আছে। ২০ থেকে ৩০ জন কীটতত্ত্ববিদ দরকার, এই ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের দুটি কীটতত্ত্ববিদের পদ আছে, এ দুজনই যথেষ্ট। তবে বিসিএসের চাকরি হওয়ায় তারা চলে যাওয়ায় পদ দুটি খালি আছে।

তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে নগরে মশক নিধনের জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যেসব ভবন বা প্রতিষ্ঠানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা ও অর্থ জরিমানা করছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউআরপি ও ডিএলআর মডিউল প্রস্তুত / মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাবে শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে

রাশিয়া শক্তিশালী, এটা মেনে নিতেই হবে : ট্রাম্প

ময়মনসিংহ থেকে বাস চলাচল শুরু, ভাঙচুরের ঘটনায় কমিটি

আইপিএলে ভালো করলেও ভারত দলে জায়গা নিশ্চিত নয়

ফেব্রুয়ারির কত তারিখে রোজা শুরু হতে পারে 

দুই শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি প্রদানের ঘটনায় আহমাদুল্লাহর উদ্বেগ

সরকারি কর্মচারীরা দাফনের জন্য পাবেন টাকা

দেড় যুগেও নির্মাণ হয়নি জহির রায়হান মিলনায়তন

দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, দুই উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি

৫ অভ্যাসে বার্ধক্যেও ভালো থাকবে হৎপিণ্ড

১০

অনশন প্রত্যাহার করল বেরোবি শিক্ষার্থীরা

১১

‘ভুল চিকিৎসায়’ একদিনে দুই শিশুর মৃত্যু

১২

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুখবর

১৩

কাভার্ডভ্যানের চাপায় মা-মেয়ের মৃত্যু

১৪

মাস্ক পরে হাসপাতালে দীপু মনি

১৫

ছাত্র সংসদের দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ ঘিরে বিভক্ত বেরোবির শিক্ষার্থীরা

১৬

বন্ধুত্ব চাইলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করুন : লায়ন ফারুক

১৭

গাজা সীমান্তে ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন করল মিসর

১৮

জাজিরা হাসপাতালে দুদকের অভিযান, অনিয়মে জর্জরিত স্বাস্থ্যসেবা

১৯

ডেজার সভাপতি প্রকৌশলী রুহুল আলম, সম্পাদক প্রকৌশলী চুন্নু

২০
X