আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় স্বস্তিতে ছিল না মানুষ। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে সীমিত আয়ের মানুষকে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ভুগিয়েছে সবচেয়ে বেশি। সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও কোনোভাবেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারেনি। সদ্য বিদায়ী সরকারের শেষ মাসেও সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও হয়েছে সর্বোচ্চ। ঊর্ধ্বগতির এই মূল্যস্ফীতির চাপ শহরের চেয়ে গ্রামে পড়েছে বেশি।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসের সিপিআই মূল্যসূচকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতির এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়লেও কমেছে মজুরি। অর্থাৎ ব্যয় বাড়লেও কমেছে আয়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় সংকটগুলোর একটি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুর মাসেও সেই সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিবিএসের জুলাই মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা আগের মাস জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ।
জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হওয়ার অর্থ হলো গত বছরের জুলাই মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে চলতি বছরের একই সময়ে ১১১ টাকা ৬৬ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাস থেকে চলতি বছরের জুলাই মাসের তুলনায় কেনাকাটায় মানুষের বেশি খরচ করতে হয়েছে।
খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি গড় মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জুলাই মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ওই মাসে চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, জুন মাসে যা ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২০০৫-০৬-কে ভিত্তিবছর ধরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকেছিল ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশে। অর্থাৎ ১৬ বছরের মধ্যে দেশে কখনো এত বেশি মূল্যস্ফীতি হয়নি।
বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন ও শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়েছে। জুলাই মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতিরে হার হয়েছে ছিল ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, জুন মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে। এ খাতেও গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে জুলাই মাসে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এতে করে দেশে এক ধরনের অচল অবস্থা দেখা যায়। ফলে ঢাকা কার্যত দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিল, বন্ধ ছিল পণ্যের সরবরাহও। আন্দোলনের ফলে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হার। তবে এক্ষেত্রে জুলাই মাসে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে এভাবে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি আর দেখা যায়নি বলেও মনে করেন তারা।
বিবিএসের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের কষ্ট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ মাসে গ্রামের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যেখানে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশে। তবে গ্রাম এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি শহর এলাকায় ছিল সবচেয়ে বেশি। গ্রাম এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, সেখানে শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে পর এ প্রথম বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এত উচ্চ পর্যায়ে ঠেকেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের নেওয়া কোনো দাওয়াইতেই কাজ হচ্ছে না। এমন সময় দেশের সুদহার বাড়ানো হয়েছে, যখন সিন্ডিকেট আরও বেশি সক্রিয় হয়েছে। পদত্যাগী গভর্নর সিন্ডিকেটের হয়েই কাজ করতেন। ফলে দেশের খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংক থেকে বেশিরভাগ নগদ অর্থ ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়ার পরই সুদহার বাড়িয়েছিলেন তিনি।
এদিকে, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের মানুষের ব্যয় বাড়লেও কমেছে আয়। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে গড় মজুরি সূচকের হার হয়েছে ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা তার আগের মাস জুনে ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে মজুরি কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে কৃষিতে মজুরি কমায় গড় মজুরি কমেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতিও আওয়ামী সরকারের পতনের অন্যতম কারণগুলোর একটি। তাদের মতে, আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের ফলে দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস উঠেছিল। খাদ্যপণ্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছিল সাধারণ মানুষের। যার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হচ্ছিল। তার একটি প্রভাব দেখা গেছে সরকার পতনে ছাত্রদের আন্দোলনে সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে বিবিএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হয় না। সব ধরনের পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও বিবিএস উল্টো হিসাব দিত। জুনেও সব পণ্যের দাম বেশি থাকলেও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে তথ্য প্রকাশ করা হয়। জুলাই মাস ছিল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস। এই মাস পরই আগস্টে আওয়ামী সরকারপ্রধান পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এ কারণে তথ্য প্রকাশে কারসাজি করা হয়নি বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।