রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন রায়ের বাজারের বুদ্ধিজীবী এলাকায় একই সঙ্গে দুজনকে কুপিয়ে হত্যার নেপথ্যে ছিল মাদক ও ছিনতাইয়ের এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার। স্থানীয় মাদক কারবারি এবং ছিনতাইকারীদের এলাকা ভাগ করা ছিল। কিশোর গ্যাংয়ের গ্রুপগুলো নিজেরা নিজেদের এলাকায় মাদক বেচাকেনা ও ছিনতাই করত। তবে এক এলাকায় ছিনতাইকারীরা অন্য এলাকায় ঢুকে ছিনতাই ও মাদক বিক্রি করার জেরে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছিল। তারা মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই গণছিনতাইয়ে লিপ্ত হতেন। এর জেরেই গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে দুজনকে একসঙ্গে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এদিকে দুজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা নিয়ে রাজনৈতিক বাণিজ্য চলছে বলেও জানা গেছে। মূল হত্যাকারীদের বাদ দিয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিকদের ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে আসামি করতে একটি মহল থানা পুলিশকে চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদক ও ছিনতাইয়ের অধিপত্য বিস্তারে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগ সহসভাপতি (বহিষ্কৃত) সাব্বির গ্রুপ ও অ্যালেক্স ইমন গ্রুপ প্রায় ৬ মাস আগে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সাব্বির আত্মগোপনে যাওয়ার পরে বর্তমানে তার গ্রুপের নেতৃত্বে আসেন শাহরুক ও আরমান নামের দুই তরুণ। এই কিশোর গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয় শাওন গ্রুপ। শাওনের বাবা মোহাম্মদপুর থানা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক। তবে বাবা শ্রমিক দল করলেও শাওন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কিলার বাদল গ্রুপের সদস্য। গত ১৯ তারিখ মোহাম্মদপুর থানাধীন ৩ রাস্তার মোড়ে শাওন গ্রুপের সদস্যরা অ্যালেক্স ইমন গ্রুপের রিফাত নামের একজনকে কুপিয়ে আহত করে। ৬ মাস আগের হওয়া আরও একটি সংঘর্ষের প্রতিশোধ নিতে দীর্ঘদিন ধরেই ওত পেতে ছিল অ্যালেক্স ইমন গ্রুপ। এরপর ১৯ তারিখের ঘটনায় আরও ক্ষুব্ধ হয় গ্রুপটির সদস্যরা। এর জেরেই ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রায়ের বাজারের সাদেক খান কৃষি মার্কেট ও আজিজ খান রোডের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নাছির বিশ্বাস (৩০) নামের এক যুবককে। এর ২-৩ মিনিট পরেই রায়ের বাজার কবরস্থানের অপর পাশে ভাঙাড়ির দোকানের ভেতরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুন্না (২২) নামের আর এক যুবককে। পুলিশের খাতায় মুন্না কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ৭-৮টি এবং নাসিরের নামে একটি মামলা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহরুক ও আরমান গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বছিলা থেকে ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড আর ঢাকা উদ্যান থেকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থান পর্যন্ত। অন্যদিকে অ্যালেক্স ইমন গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা। শাহরুক এবং আরমান গ্রুপকে সাবেক দুই কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ এবং ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আটক হওয়া তারিকুজ্জামান রাজীবের বিরুদ্ধে আসকারা দেওয়ার অভিযোগ ছিল পুরোনো। বছিলা থেকে ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড আর ঢাকা উদ্যান থেকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থান পর্যন্ত সব ধরনের ছিনতাই, মাদক কেনাবেচাসহ সব অপকর্মের হোতা শাহরুক ও আরমান গ্রুপের সদস্যরা। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে শাহরুক আরমান গ্রুপের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে শাওন গ্রুপ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাছির বিশ্বাস একটি মোটরসাইকেলযোগে বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন শাওন। সাদেক খানের কৃষি মার্কেটের সামনে গিয়ে মোটরসাইকেল জ্যামে আটকা পড়ে। এমন সময় কয়েকজন যুবক এসে মোটরসাইকেলে থাকাবস্থায় কোপ দেয় নাছিরকে। এরপর মোটরসাইকেল থেকে নেমে জীবন বাঁচাতে দৌড় দিলে আজিজ খান রোডের সামনে গিয়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় নাছির। এমন সময় তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চাপাতির উল্টো পাশ দিয়ে আঘাত করা হয় শাওনকেও।
শাওন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘নাছির আমার এলাকার ছোট ভাই। ও তিন রাস্তার মোড়ে যাবে বলছিল। পরে ওরে নিয়ে আমি বাইকে করে যাচ্ছিলাম। এমন সময় কৃষি মার্কেটের সামনে গেলে কয়েকজন এসে কোপাতে থাকে।’ তিনি অসুস্থ, এর বেশি আর কথা বলতে পারবেন না বলে ফোন কেটে দেন।
অন্যদিকে মুন্না বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ভেতরে থেকে বের হলে গেটের সামনে তাকে প্রথমে একটি কোপ দেওয়া হয়। কোপ খেয়ে মুন্না মাটিতে পড়ে গেলে অন্যপাশে থাকা ভাঙাড়ির দোকানের গলির ভেতরে নিয়ে গিয়ে ৩ মিনিট ধরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মুন্নাকে হত্যার ৩ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে কালবেলার হাতে। ফুটেজে দেখা যায়, প্রথম ৫-৬ জন তরুণ মুন্নাকে ফেলে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছেন।
হত্যাকারীদের মধ্যে লম্বা একজনকে অ্যালেক্স ইমন হিসেবে শনাক্ত করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। বাকিদের মধ্যে আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ সূত্রে। জানতে চাইলে নিহত মুন্নার বাবা বাবুল আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গেছিল খেলতে। ফেরার পথেই তারা এভাবে কুপিয়ে মারল। আমার ছেলে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে থেকে হয়তো কয়েকটি মামলার আসামি, তবে খারাপ কিছু করেনি।’
জোরাখুনের ঘটনায় মিরাজ নামের একজনকে আটক করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। এরপর আদালতের মাধ্যমে তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে রাজনৈতিক রূপ দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে একটি গ্রুপ। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক ব্যক্তি কালবেলাকে জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে মামলা বাণিজ্য চলছে। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে আসামি করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির অনেক নেতাকেও প্রতিপক্ষ গ্রুপ এ মামলায় ফাঁসানোর চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা একজনকে আটক করে রিমান্ডে এনেছি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’