হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার সড়কে ৭ বছর ধরে চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ। দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ানো প্রকল্পটি চলতি বছরের আগস্ট মাসে খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। অবকাঠামোর ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হলেও কবে নাগাদ বাস চলা শুরু করবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ চলমান থাকায় সুফলের বদলে যেন গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে প্রকল্পটি।
এ ছাড়া ফুটপাতের ওপর স্টেশন নির্মাণ করায় দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। বিশেষ লেনের দুই পাশে বিভাজক না রাখা এবং সড়কের পাশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের চলাচলের সুযোগ না থাকায় প্রকল্পের সামগ্রিক সুফল নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। যানজট, ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে।
গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হোসাইন মো. শাহিন বলেন, বিআরটি অংশ বাদ দিলে এই সড়কে একটি করে লেন। একটি লেন দিয়ে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে না।
প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ভুল পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কথা ভাবা হয়নি। তারা কিন্তু বিআরটি বাসে উঠবেন না। তাদের হাঁটার জায়গাও বন্ধ হচ্ছে। এই প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবে এর ভবিষ্যৎ খারাপ।
বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক ইলিয়াস শাহ বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলতে বা শঙ্কা প্রকাশ করতে পারেন। প্রকল্প চালু হলে বলা যাবে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প কয়েক দফায় বাড়িয়ে করা হয় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার। এমন প্রকল্প বিশ্বের আরও অনেক দেশে বাস্তবায়ন হলেও এত সময় আর অর্থ লাগেনি কোথাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গলদটা গোড়াতেই ছিল। জনগণ নয়, নিজেদের স্বার্থেই নেওয়া হয়েছে এমন প্রকল্প।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এই প্রকল্প সিক প্রজেক্ট। পরিকল্পনা, নকশা থেকে সব কিছুতেই ব্যক্তি স্বার্থের কথা চিন্তা করা হয়েছে। ফান্ডিং এজেন্সি নিজের ফান্ডের কথা চিন্তা করেছে। করিডোরের ক্যারেক্টারের দিকে যায়নি। যদি করিডোরের ক্যারেক্টারটা দেখত, তা হলে তারা প্রথমদিনেই বলত দিজ ইস নট ফর বিআরটিএ। প্রায় ১৩ বছর লাগিয়ে শেষ হয়েছে অবকাঠামোর ৯৭ ভাগ কাজ। এরপর পরিচালনায় আরও কত সময় যাবে, দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিআরটি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মো. মহিউদ্দিন বলেন, যদি আমরা অন টাইমে ডেলিভারি পাই, তাহলে ফেব্রুয়ারি-মার্চের পর অপারেশনে যাওয়া সম্ভব হবে।
এদিকে, পুরোপুরি কাজ শেষ না হওয়ায় কাটছে না ভোগান্তি। বিশেষ করে গাজীপুর চৌরাস্তা সড়কের ওপরেই চলছে ফ্লাইওভার ও স্টেশন নির্মাণের কাজ। এতে যানজট ভোগান্তি আর দূষণে নাকাল এই পথের যাত্রীরা।
গাজীপুরের গাজীপুরা স্টেশনসহ প্রকল্পের কয়েকটি স্টেশনের পিলার ও সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে ফুটপাতের ওপর। ফলে ফুটপাত না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই প্রতিনিয়ত চলাচল করছেন পথচারীরা। যেসব জায়গায় স্টেশনের কারণে ফুটপাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসব স্থান সহায়ক প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ করে ফুটপাত সম্প্রসারণের কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। যদিও এমন প্রকল্পকে দায় এড়ানোর চেষ্টা বলছেন শামসুল হক।
জানা গেছে, অর্থায়ন সংকট, কাজের ধীরগতি আর নির্ধারিত সময়ে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায় চীনা দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের কথা ভাবছে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি। এতে সংকট আরও বাড়ার শঙ্কা যোগাযোগ বিশেষজ্ঞের।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশে টেন্ডারে যাওয়া, নতুন করে টেন্ডার দেওয়া, টেন্ডার বাছাই করা—এই প্রক্রিয়াটি আমার মনে হয় সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এটা কালক্ষেপণ হবে। প্রকল্পের খরচের আরও মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
২০১৭ সালে শুরু হওয়া বিআরটি প্রকল্প আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করার তাগিদ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে কাজের যে অগ্রগতি, সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন সংকটে কাজ চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ফলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর তো নয়ই, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরেও পুরোপুরি চালু হয় কি না, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার বছর মেয়াদ ছিল প্রকল্পটির। কিন্তু কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। পরে তিন দফা প্রকল্প সংশোধন করে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। তিন দফা সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। শুরুতে প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ছিল চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত। পরে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হলেও প্রকল্পটি সংকুচিত করে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
প্রকল্পে এলিভেটেড (উড়াল অংশ) থাকছে ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার। স্টেশন ২৫টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৪টি ও গাজীপুর মহানগরীতে পড়েছে ২১টি। উড়াল সড়ক থাকছে ৯টি, প্রতিটি স্টেশনেই থাকবে পদচারি সেতুর ব্যবস্থা। প্রকল্পের ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে সওজের কাজ ১৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৯টি উড়াল সড়ক। উড়াল সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। এলজিইডির আওতাধীন দুটি প্যাকেজের অগ্রগতি শতভাগ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯০ শতাংশ।