

বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসকে কেন্দ্র করে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা অবসানের লক্ষ্যে ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়। ১৬ দিনব্যাপী এই আয়োজন আমাদের নারীর প্রতি বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্য মনে করে দেয়। নারীর প্রতি বৈষম্য নানা কারণে ঘটে, যার মধ্যে নিবন্ধনহীনতা অন্যতম। প্রতিটি নারীর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অত্যন্ত জরুরি। এই নথিটিই রাষ্ট্রের চোখে নারীর জীবনকে দৃশ্যমান করে তোলে, অথচ আজও দেশের লাখো নারীর কাছে এটি অধরা। বর্তমান জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০০৪ নারীর অধিকার সুরক্ষায় যথেষ্ট কার্যকরী নয়। ফলে অধিকাংশ নারীই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অদৃশ্য রয়ে যাচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে মৌলিক অধিকার থেকে।
জন্মনিবন্ধন না থাকলে শিশুকাল থেকেই শুরু হয় বৈষম্য। বয়স প্রমাণের অভাবে সহজেই বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়। গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১.৪ শতাংশেরই বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে এবং এদের মধ্যে প্রারম্ভিক মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মাতৃমৃত্যুর হার বেশি। বর্তমানে দেশে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মা হচ্ছেন ২৪ শতাংশ নারী। বাল্যবিবাহের সঙ্গে আরও জড়িয়ে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার ঝুঁকি, প্রায় ২৮ শতাংশ কিশোরী স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। জন্ম নিবন্ধন নেই মানে সব পথেই বাধা যেমন স্কুলে ভর্তি, চাকরিতে সমান সুযোগ কিংবা সম্পত্তির অধিকার।
গবেষণা বলছে, সম্পত্তিহীন, প্রান্তিক ও দরিদ্র নারীদের মৃত্যু নিবন্ধন বেশ কম। একজন নারীর মৃত্যু নথিভুক্ত না হলে রাষ্ট্র জানতে পারে না সে কী রোগে, কী কারণে মারা গেছে, ফলে নারীর স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে সঠিক নীতি প্রণয়ন করা যায় না। সহিংসতা ঘটিত নারীর মৃত্যু সরকারি নথিতে অন্তর্ভুক্ত না হলে, সেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা কঠিন হয়। ফলে, অপরাধী শাস্তি এড়িয়ে যায়, তদন্তে গাফিলতি হয় এবং ন্যায়বিচার নাগালের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্র জানতে পারে না কোন অঞ্চলে সমস্যা বেশি, কোনো ধরনের সহিংসতা বাড়ছে। ফলস্বরূপ, প্রতিরোধমূলক নীতি, আশ্রয়কেন্দ্র, সহায়তা সেবাসহ অন্যান্য সরকারি পদক্ষেপগুলো অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন, ২০০৪-আইন অনুযায়ী জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। আইনটি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে এই আইনে কিছু ঘাটতি রয়েছে। আইনে জন্ম ও মৃত্যুর তথ্য দেওয়ার দায়ভার পরিবারের ওপর। অথচ দেশের প্রায় ৬৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হাসপাতালেই ঘটে, তবুও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আইনগত দায়িত্ব নেই নিবন্ধনের। এক্ষেত্রে নারীরাই সমস্যায় পড়ে বেশি। অনেক দরিদ্র পরিবার মেয়ের জন্ম নিবন্ধনকে অগ্রাধিকার দেয় না। আবার দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে খুব কম নারী জমি বা অন্য সম্পত্তির মালিক থাকে। সুতরাং পরিবারের সদস্যরা তাদের মৃত্যু নিবন্ধনের কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। আইন সংশোধন করে হাসপাতালগুলোকে নিবন্ধনের জন্য দায়বদ্ধ করা হলে, প্রতিটি নারীর জন্ম ও মৃত্যু স্বয়ংক্রিয়ভাবে নথিভুক্ত হবে।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বহু দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে এবং প্রায় শতভাগ নিবন্ধন অর্জন করেছে। বাংলাদেশও এটি জরুরি কারণ বাংলাদেশের অবস্থান এক্ষেত্রে খুবই উদ্বেগজনক। জন্ম নিবন্ধনের হার ৫০ শতাংশ এবং মৃত্যু নিবন্ধনের হার মাত্র ৪৭ শতাংশ। এই ঘাটতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী নারীরাই। তাই এখনই প্রয়োজন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ দ্রুত সংশোধন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আইনগতভাবে নিবন্ধনের দায়িত্ব প্রদান করা, ৪৫ দিনের মধ্যে ভুল সংশোধনে ফি বাতিল এবং ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস তৈরিতে নিবন্ধন ডাটা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। পাশাপাশি, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনকে নারীদের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রচার করা। সহজ সফটওয়্যার ব্যবহার, নিবন্ধকদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নারীর পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। এটি ছাড়া নারীরা পরিসংখ্যানে, নীতিতে এবং অধিকার প্রয়োগে থাকে অদৃশ্য। তাই নারীর অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষায় শক্তিশালী জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন এখন সময়ের দাবি। লেখক : কোঅর্ডিনেটর, প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান), ই-মেইল : [email protected]
মন্তব্য করুন