কাজী মনজুরুল ইসলাম ও আসিফ পিনন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০২:৫২ এএম
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৩:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘আষাঢ়ে গল্পে’ ভাসছে চট্টগ্রাম নগরী

সিডিএ-চসিক জলাবদ্ধতা নিয়ে মুখোমুখি
‘আষাঢ়ে গল্পে’ ভাসছে চট্টগ্রাম নগরী

বর্ষার আগেই নগরের ড্রেন পরিষ্কারে মাঠে নামছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। জলজট প্রবণ এলাকায় যাচ্ছে চসিকের সমন্বিত টিম। বর্ষা শুরুর আগে জলাবদ্ধতা ঠেকাতে এভাবেই প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিল সংস্থাটি। এরপর আষাঢ় গেল শ্রাবণ এলো, তারপর দুদিনের টানা বৃষ্টিতেই তলিয়ে গেল নগরীর নিচু এলাকা। বেশ কয়েক বছর ধরে এভাবেই কখনো জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, কখনো খাল খনন কিংবা ড্রেন খাল পরিষ্কারের নতুন নতুন প্রকল্পের আশ্বাস মিলছে। তবে মুক্তি মেলেনি জলাবদ্ধতা থেকে। বরং বৃষ্টি-জোয়ারে যখন নগরী একাকার, তখনই জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও সিটি করপোরেশন দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি অবস্থানে। দুই সংস্থা একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে শুনিয়েছে সমন্বয়হীনতার কথা।

বাসিন্দারা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই নগরীর ৩৬টি খাল খনন, খালের মুখে টাইডাল রেগুলেটর ও ড্রেন সম্প্রসারণের কথা শুনিয়ে আসছিল এসব সংস্থা। এসবের মধ্যেই শোনা যায় বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত বারইপাড়া খাল খননের কথা। সর্বশেষ বর্ষা শুরুর আগে নগরীর জমাটবদ্ধ ড্রেন-নালা পরিষ্কারের আশ্বাস দিয়েছিল চসিক। কিন্তু সামান্য বৃষ্টিতেই সব সংস্থার উদ্যোগে ‘জল ঢেলে’ কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায় নগরী। এ যেন জল নয়, নগরী ভাসছে আষাঢ়ে গল্পে। গত বর্ষায় টইটম্বুর পানিতে ড্রেন-খালে পড়ে পথচারী নিহত ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটে এ নগরীতে। এ প্রসঙ্গ টেনে কায়সার আলী নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট করেন, ‘বাসায় থাকুন, নালায় পড়ে মৃত্যুবরণ করলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে। চট্টগ্রাম পানির নিচে, অতিপ্রয়োজন না হলে বাসা থেকে বের হবেন না। নিকট অতীতে নালাতে পড়ে মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এরপরও টনক নড়েনি সেবা সংস্থাগুলোর। দেওয়া হয়নি স্ল্যাব কিংবা নিরাপত্তা বেষ্টনী।’

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নতুন প্রকল্প নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। প্রকল্প বাগিয়ে নিতে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি থাকে না। কিন্তু তা বাস্তবায়নে দেখা যায় ঢিলেমি।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর এবং অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘জলাবদ্ধমুক্ত নগরী গড়তে হলে প্রথমত নগরের বাসিন্দাদের সচেতন হতে হবে। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএ, চসিক, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্থাগুলো একে অন্যকে দোষ দিতে ব্যস্ত থাকে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা অনেক পুরোনো। তাই এ সমস্যা সমাধানের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ, সেটি আমরা বুঝি। সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে সংস্থাগুলো যদি সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করত, সমস্যাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করত, তাহলে ভালো হতো।

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকায় চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিন সংস্থা। সিডিএ ও চসিকের সঙ্গে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো)। দীর্ঘদিনের অভিযোগ এই তিন সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই। কারও কথা কেউ না শুনে যার যার মতো কাজ করছে। এতে প্রকল্পগুলো এগোচ্ছে ধীরগতিতে। দীর্ঘদিন প্রকল্প চলমান থাকায় দুর্ভোগ বাড়ছে।

সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে সিডিএ। ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এই প্রকল্প ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাস্তবায়ন শুরু হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। বছর শেষেও এ প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে আরেক দফা ব্যয় ও সময় বাড়াতে প্রস্তাব গেছে মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়া ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ নামে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থাটি। ২০১৭ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নেও অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি।

এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস কালবেলাকে বলেন, সিডিএ কাজ করছে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি খাল নিয়ে। নগরীতে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার ড্রেন আছে। এর মধ্যে আমরা মাত্র ৩০০ কিলোমিটার নিয়ে কাজ করছি। বাকিগুলো কিন্তু সিটি করপোরেশনের। রাস্তার দুপাশে যে মাইনর ড্রেন আছে, সেগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, মূল খালে কোনো পানি থাকে না, তারপরও রাস্তা ডুবে থাকে। মাইনর ড্রেনগুলো পরিষ্কার না করার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সিডিএর প্রকল্পের বাইরে যে খাল-নালা আছে, সেগুলোও নিয়মিত পরিষ্কার হচ্ছে না। বিশাল বর্জ্য খালের মধ্যে পড়ে আছে। সেই কারণে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হতে পারছে না। জলাবদ্ধতার এটিও একটি বড় কারণ। চট্টগ্রাম নগরীর একটি বড় এলাকায় পানি প্রবাহিত হয় চাক্তাই খাল দিয়ে। এক খাল দিয়ে এত বড় এলাকার পানি কর্ণফুলী নদীতে দ্রুত যাওয়া সম্ভব নয়। ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে বড়ইপাড়া খাল খনন করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বড়ইপাড়া খালটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১০ বছরেও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় প্রবর্তক থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত খালের কাজ করা যায়নি। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের ব্যয় ৫ হাজার কোটি থেকে বেড়ে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার একটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে গেছে। কিন্তু তা এখনো অনুমোদন হয়নি। প্রকল্পের অধীনে ১৭টি স্লুইসগেট আছে। এগুলো এখনো ফাংশনাল হয়নি। স্লুইসগুলো ফাংশনাল হতে আরও এক বছর সময় লাগবে।

অন্যদিকে নগরের বহদ্দারহাটের বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খননের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চসিক। বরাদ্দ ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)। মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘নগরবাসী আমাদের গালাগাল করছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা প্রকল্পে করপোরেশনের কোনো হাত নেই। সিডিএকে বলেছি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য। এই পর্যন্ত সিডিএ কি কোনো কাউন্সিলরকে ডেকেছে? সিডিএ নিজের মতো করে কাজ করছে। করপোরেশন সবসময় খাল-নালা পরিষ্কার করে আসছে। বারৈপাড়া খালের কাজও চলছে।

নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে পাউবো ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ‘মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রকল্পের অধীন কর্ণফুলীতে যুক্ত ২৩টি, হালদায় যুক্ত তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে যুক্ত ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। এতদিনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ অবস্থায় দুদিনের বৃষ্টি জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে নগরের অধিকাংশ এলাকা। দেশের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন নিচু এলাকা পরপর দুদিন পানিতে ডুবে যায়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ নারীকে ধর্ষণসহ ৩২ অভিযোগে ক্রাউন প্রিন্সেসের ছেলের বিচার শুরু

বিএনপির দলীয় কার্যালয় ফিরে পেতে ১৬ বছর পর মামলা

১৩ ঘণ্টা পর ভেসে উঠল নাজিমের নিথর দেহ

দেশের সব সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত

জুটি বাঁধছেন মিঠুন-রজনীকান্ত

বাংলাদেশ বিমানের ১০টি চাকা চুরি!

পশ্চিম দিকে থুথু ফেলা কি জায়েজ আছে?

নিজ বাসভবনে হামলার শিকার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী

ই-কারের ভাড়া ৫ টাকা করার দাবি চবি ছাত্রশিবিরের

কেশবপুরে নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত 

১০

বিশ্বসুন্দরী মঞ্চে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি নাহিন আইয়ুব

১১

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তুষার নিখোঁজ

১২

নীরবে শরীরে যে ৭ ক্ষতি করছে ইউরিক অ্যাসিড

১৩

ডুবুরিদের ৩ ঘণ্টার চেষ্টাতেও সন্ধান মেলেনি শিশু নাজিমের

১৪

ভাত ছেড়ে দিলেই কি ওজন কমবে? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

১৫

কানাডা মাতাতে যাচ্ছেন জায়েদ খান

১৬

মৃত্যুর কারণ চিরকুটে লিখে গেলেন নাসরিন

১৭

সড়কে মিলল ৬ পুরুষের কাটা মাথা, দেহ গায়েব

১৮

ড্যাবের নবনির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর

১৯

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ৫৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

২০
X