রক্তের চাহিদা চিরন্তন। জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। তবে সচেতনতা ও তদারকির অভাবে এখনো শতভাগ রক্তের পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের প্রায় ৬২টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এখনো বাংলাদেশে রক্তের জোগান দেন রোগীর আত্মীয়-স্বজন। উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার প্রতি হাজারে ৪৫ জন। দেশে এই সংখ্যা প্রতি হাজারে ৪ জনেরও কম। ঘাটতি পূরণ ও অনিরাপদ রক্তের ব্যবহার বন্ধে মাত্র ৫ লাখ ব্যাগ অতিরিক্ত সংগ্রহ করতে হবে। ৬ থেকে ৭ লাখ লোক যদি বছরে অন্তত দুবার রক্তদান করেন, তাহলেই এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তগ্রহীতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রক্তদানের আগে অত্যাবশ্যকীয় পাঁচটি পরীক্ষার বিধান রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে মাঠপর্যায়ে এর বাস্তবায়ন নেই। স্বল্প পরিসরে যতটুকু নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে, তাতে গত চার বছরে দেশে ১৮৯ জনের দেহে প্রাণঘাতী এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়েছে। ফলে পরীক্ষা ছাড়া রক্ত গ্রহণে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভিসহ প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
দেশে রক্ত চাহিদার একটা বড় অংশ প্রয়োজন হয় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য। হেমাটোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ সূত্রে জানা যায়, দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০
হাজার। থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখেরও অধিক মানুষ। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রতি মাসে ১ থেকে ৩ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। থ্যালাসেমিয়া ছাড়াও রক্তস্বল্পতা, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অগ্নিদগ্ধ রোগী, বড় অপারেশন, দুর্ঘটনা ইত্যাদি নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের এ চাহিদা পূরণে নতুন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার কোনো বিকল্প নেই। সাধারণত ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যে কোনো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, সক্ষম ব্যক্তি প্রতি চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রক্তদান ও গ্রহণে জনসচেতনতা তৈরিতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ বুধবার ১৪ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস-২০২৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘রক্ত দান করুন, দান করুন প্লাজমা, যতবার সম্ভব গ্রহণ করুন জীবন বাঁচানোর এ অনন্য সুযোগ।’ দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে এ বিষয়ে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা আয়োজনের কথা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় বছরে প্রায় ১০ লাখ ব্যাগ রক্ত দরকার হয়। সারা দেশে সরকারি ২০৬টি এবং বেসরকারি ১৭২টি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৯৯টি এবং ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ারের কর্মসূচির মাধ্যমে ১২৪টি সরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও বিশেষায়িত ব্লাড ব্যাংকে রক্তদাতাদের স্ক্রিনিং করে ২০১৯ সালে ৬৪, ২০২০ সালে ৪৭ ও ২০২১ সালে ২৮ জনের এইডস শনাক্ত হয়। ২০২২ সালে ৫০ জনের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে চার হাজার ৯২৮ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার শরীরে হেপাটাইটিস-বি ও ২১৮ জনের হেপাইটিস-সি ভাইরাস শনাক্ত হয়। এ ছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে ২ হাজার ২১২ জনের যৌনবাহিত সিফিলিস রোগ ধরা পড়ে। এ বছর মোট ৯ লাখ ৬০ হাজার ৯৮১ ব্যাগ সরকারি-বেসরকারিভাবে রক্তদান করা হয়েছে। এসব রক্তদানের মধ্যে নিকটাত্মীয়ের সংখ্যা বেশি। ৭ লাখ ২৭ হাজার ৮১০ ব্যাগ রক্তদানই নিকটাত্মীয়ের। ২ লাখ ৩৩ হাজার ১৭১ জন স্বেচ্চায় রক্ত দিয়েছেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিদম ব্লাড ব্যাংকের পরিচালক ডা. এস এম মামুন কালবেলাকে বলেন, দেশে পেশাদার রক্তদাতার সংখ্যা অনেকাংশে কমে এসেছে। একসময় যেখানে সিংহভাগ রক্তের চাহিদা মেটাত পেশাদার রক্তদাতা। এখন সেখানে ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ রক্ত রিলেটিভ থেকে আসে। ৩৪ শতাংশ রক্ত দেয় স্বেচ্ছাসেবীরা। আর মাত্র ১১ থেকে ১৬ শতাংশ রক্ত দেয় পেশাদাররা। আমরা চাই রোগীর প্রয়োজনে রক্তদান নয়, চার মাস পরপর স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিত রক্তদান করুক। এতে চাহিদার অনুপাতে রক্তের জোগান পাওয়া যাবে। রক্তের অভাবে কেউ মারা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থ্যালাসেমিয়া ম্যানেজমেন্ট শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আতাউল করিম কালবেলাকে বলেন, পেশাদার রক্তদাতা মানে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ রক্তের জোগান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎপরতায় সেটা কমে এসেছে। এখন আর আগের মতো রক্তের জন্য হাহাকারও নেই। এখন রক্ত চেয়ে খোঁজা হলে রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা চাই রক্তদাতাদের একটি সুবিন্যাস্ত তথ্য থাকবে। সুস্থ থাকলে চার মাস অন্তর অন্তর নিয়মিত রক্ত দেবেন। তাহলে রক্তের অভাবে কোনো মৃত্যু হবে না।
কর্মসূচি: বাংলাদেশে আজ বুধবার দিবসটি পালনে সরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি এবারও এগিয়ে আসছে সাড়ে চার লক্ষাধিক সুসংগঠিত ডোনার পুল নিয়ে গঠিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। বিকেলে রাজধানীর কাকরাইলের আইডিইবি ভবনে প্রথমবারের মতো দুই শতাধিক স্বেচ্ছায় রক্তদাতা ও দুই শতাধিক থ্যালাসেমিক রক্তগ্রহীতার মিলনমেলা এবং বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করছে কোয়ান্টাম।
মন্তব্য করুন