যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অবশ্য বাংলাদেশের এলএনজি আমদানি বাড়ার তথ্য দিলেও এর আর্থিক মূল্য প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ইআইএর প্রতিবেদন বলছে, আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরের মাস সেপ্টেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানি বেড়ে যায়। অক্টোবরে এ আমদানির পরিমাণ আরও বাড়ে। এর মধ্যে সম্প্রতি বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি আমদানি করতে মার্কিন কোম্পানি আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে একটি নন-বাউন্ডিং চুক্তি করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন কোম্পানি থেকে এলএনজি কেনা বাড়লেও এটা ‘জিওপলিটিক্স’ হিসেবে দেখা যাবে না। এ মুহূর্তে বিশ্বে খোলা বাজারে মার্কিন কোম্পানিগুলো কম খরচে এলএনজি বিক্রি করছে। বাংলাদেশ সেই সুবিধা নিয়েছে বা নিচ্ছে। তবে সম্প্রতি মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে এলএনজি ক্রয়ে করা নন-বাইন্ডিং চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কোনো পদক্ষেপ নিলে বুঝতে হবে এখানে ‘জিওপলিটিক্স’ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে দেখতে হবে ব্যবসা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয়। খুব সতর্ক থাকতে হবে এক্ষেত্রে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর অর্থাৎ জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কোনো কর্মকর্তাই আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি। অবশ্য একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ বিধান বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর বিশ্বের খোলা বাজার থেকে দরপত্রের মাধ্যমে এলএনজি কেনা হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন কোম্পানিগুলোর দরই ছিল সবচেয়ে কম।
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মার্কিন এলএনজি আমদানি বাড়াটা স্বাভাবিক। কারণ গত বেশ কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক খোলা বাজারে (স্পট মার্কেটে) মার্কিন কোম্পানিগুলো কম দামে এলএনজি বিক্রি করছে। এখন কম দামের এলএনজি যদি পদ্ধতিগতভাবে কেনে, তাহলে কিছু বলার নেই। আগে বিশেষ আইনের আওতায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হলেও এখন তো দরপত্রের মাধ্যমে কেনা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে নন-বাইন্ডিং চুক্তি হয়েছে, তার আওতায় যদি এলএনজি কেনা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এখানে ‘জিওপলিটিক্স’-এর বিষয় আছে। তবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি কিনছে। ওই বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ প্রথম ৩ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৬০ মিলিয়ন ঘনফুটে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয় ৩৭ হাজার ৭৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ে। ফলে বিশ্বের খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ। যে কারণে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট। এর পরের দুই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি আবার বেড়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে আবারও এলএনজির দাম কমতে শুরু করলে স্পট মার্কেট থেকে কেনা বাড়ায় বাংলাদেশ। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট ২৪ হাজার ১৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আসে দেশে।
ইআইএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২৬ হাজার ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর মধ্যে গত বছরের মার্চে ৩ হাজার ২৮১ মিলিয়ন ঘনফুট, এপ্রিলে ৩ হাজার ২৮৯ মিলিয়ন ঘনফুট, জুনে ৩ হাজার ২৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কেনা হয়। জুলাই-আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো এলএনজি কেনা হয়নি। আগস্টে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পরের মাস সেপ্টেম্বরে এলএনজি কেনার পরিমাণ বেড়ে যায়। সেই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬ হাজার ৩২৮ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কেনা হয়। পরের মাস অক্টোবরে এ পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯১৮ মিলিয়ন ঘনফুটে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকটের কারণে দেশে ২০১৮ সালে প্রথম এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। ওই বছর ২৫ এপ্রিল প্রথম জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং এ ব্যবসায় যুক্ত হয়। ভাসমান টার্মিনাল তথা ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানিকৃত এলএনজি রিগ্যাসিফাইড করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
এ ছাড়া এলএনজি কেনার জন্য কাতারের রাস লাফান লিকুইফাইড ন্যাশনাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৭ সাল এবং ওমানের ওকিউ ট্রেডিংয়ের সঙ্গে ২০১৮ সালে দুটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। সরকারি পর্যায়ের এই দুই চুক্তির আওতায় কাতার ১৫ বছর এবং ওমান ১০ বছর বাংলাদেশের কাছে এলএনজি বিক্রি করবে।
মহেশখালীতে সামিটকে আরও একটি ল্যান্ডবেজ টার্মিনাল ও পায়রায় এক্সিলারেট এনার্জিকে একটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের অনুমতিও দিয়েছিল হাসিনা সরকার। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো বাতিল করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এলএনজি ব্যবসায় এ দুই প্রতিষ্ঠানের ওপর একচেটিয়া ব্যবসা কমাতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই অংশ বিনা দরপত্রে সামিটকে দেওয়া দ্বিতীয় টার্মিনালের কাজ বাতিল করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ দায়মুক্তি আইনে দেওয়া লাইসেন্সটি গত ১৪ জানুয়ারি বাতিল করা হয়। এর আগে ২০২৩ সালে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এলএনজির সঙ্গে সই করা টার্মশিটও গত বছর ১৬ অক্টোবর বাতিল করা হয়।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমেই দাম বাড়ায় এলএনজি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ ইকোনমিক ডেটার তথ্যমতে, গত বছর জানুয়ারিতে স্পট মার্কেটে প্রতি ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম ছিল ১০ দশমিক ০১৬৮। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৮২২৩ ডলার। তবে মে মাসে তা আবার ১০ ডলার ছাড়ায়। জুনে তা ১২ ডলার ছাড়িয়ে যায়। জুলাইয়ে সামান্য কমলেও আগস্টে ১৩ ডলার ছাড়ায়। পরের দুই মাসও এ দাম ১৩ ডলারের ওপরই ছিল। নভেম্বরে তা ১৪ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি কেনার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।