করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ও উপধরনের সংক্রমণ চোখ রাঙাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের দু-একটি সাব-ভ্যারিয়েন্টের (উপধরন) সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও থাইল্যান্ডের পর বাংলাদেশেও নতুন একটি উপধরনের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধে কিছু নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়নে লোকবলের অভাব রয়েছে।
সম্প্রতি দ্বিতীয় সংশোধিত কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ হওয়া ১ হাজার ৪ জন অস্থায়ী জনবল ছাঁটাই করা হয়েছে। আগামীতে কভিড সংক্রমণের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আইসোলেশন, হাসপাতালে চিকিৎসাসহ টিকা প্রয়োগে ব্যাপক সংকট তৈরি হতে পারে। জনবলের অভাবে এখনই সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে প্রকল্পের ১৩তম স্টিয়ারিং কমিটির সভায় উঠে এসেছে। আগামীতে কভিড সংক্রমণ বাড়লে জনবলের অভাবে স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ববিদ ড. মুশতাক হোসেন বলেছেন, এমনিতে আমাদের টেকনোলজিস্টের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। শুধু কভিড নয়, ডেঙ্গু এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল আমাদের দরকার। কভিড ও ডেঙ্গুর মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের স্বাস্থ্য জনবলে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প শেষ বলে ইআরপিপির প্রশিক্ষিত কর্মীদের বাদ দিতে হবে—এটা সমীচীন নয়। কতকাল আর বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হবে, সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অবিলম্বে এদের স্বাস্থ্যসেবা যুক্ত করা জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জনা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (দ্বিতীয় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃক অনুমোদিত ১ হাজার ১৫৪ জন জনবলের মধ্যে ১ হাজার ৪ জন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদানের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে জুনিয়র কনসালট্যান্ট অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, মেডিকেল অফিসার (আইসিইউ), ল্যাব কনসালট্যান্ট, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিনিয়র স্টাফ নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, কম্পিউটার/ডাটা অপারেটর, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট, ওয়ার্ডবয়, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৩ (৮) অনুযায়ী গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ, আইসোলেশন ইউনিট এবং আরটিপিসিআর সংবলিত আধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, এপিডেমিওলজিক্যাল ইউনিটসহ অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল। এসব জনবলের সেবা মূল্য প্রকল্পের আরপিএ বরাদ্দ থেকে পরিশোধ করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ইআরপিপি (দ্বিতীয় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ৭ জুলাই অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদকাল এপ্রিল ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পর চুক্তি বাতিল করা হয়।
প্রকল্পে যারা কর্মরত ছিলেন তাদের মধ্যে জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া/ক্রিটিক্যাল কেয়ার) হিসেবে ১৬ জন, মেডিকেল অফিসার (আইসিইউ) হিসেবে ৮০, ল্যাব কনসালটেন্ট হিসেবে ৩০ জন, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করেছেন তিনজন। এ ছাড়া সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে ১৫০ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে ১২৬, কম্পিউটার/ডাটা অপারেটর পদে ১৯০, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পদে ৫১, ওয়ার্ড বয় ১০৪, আয়া ১০৩ এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে ১৫১ জন, সব মিলিয়ে মোট এক হাজার ৪ জন।
এ জনবলের মধ্যে ২৫৯ জন রাজধানীর বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ১৫৩ জন বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এবং ৫৯২ জন দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে কভিড রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ছিলেন।
এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ইআরপিপি প্রকল্পে স্টিয়ারিং কমিটির ১৩ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্পে কর্মরত জরুরি জনবলের চুক্তি বর্ধিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
সেখানে বলা হয়, আইসিইউ, মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, এপিডেমিওলজিক্যাল ইউনিটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদানের জন্য জনবল গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিল। এর পর থেকে জনবল ছাড়া চলমান সেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রকল্পে আওতায় আউটসোর্সকৃত জনবলের মেয়াদ বাড়াতে অর্থ বিভাগের সম্মতি গ্রহণে চিঠি পাঠানো হবে। প্রকল্পের জিওবি বরাদ্দের রাজস্ব অংশে অব্যয়িত অর্থের আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাব করতে হবে। অর্থ বিভাগের সম্মতি ও আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে উত্তর জনবলের সেবা ব্যবহার করতে হবে।
কিন্তু গত ৫ মে যুগ্ম সচিব শারাবান তাহুরার সই করা এক চিঠিতে জানানো হয়, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় আউটসোর্সিংয়ের এক হাজার ৪ জন জনবল নতুন করে রাজস্ব খাতের অব্যয়িত অর্থ থেকে সেবামূলক পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রকল্পের জনবলের সেবামূল্য প্রকল্পের আরপিএ বরাদ্দ হতে পরিশোধ করা হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ চলতি মাসের ৩০ জুন পর্যন্ত হলেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তির মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। প্রকল্পে নিয়োজিত জনবলের বেতন-ভাতাদি আরপিএ থেকে বরাদ্দ প্রদান করা হতো এবং জিওবি অংশে কোনো বরাদ্দ প্রদানের সংস্থান রাখা হয়নি। সুতরাং আরপিএ অংশের পরিবর্তে জিওবি অংশের আন্তঃখাত সমন্বয় করে বেতন ভাতা প্রদান করতে হলে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের কোনো অনুমোদন নেই। তা ছাড়া প্রস্তাবিত ১ হাজার ৪ জন জনবল আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগবিষয়ক অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের সম্মতির কোনো প্রমাণক নেই। দাখিলকৃত কাগজপত্র মোতাবেক, প্রস্তাবিত জনবল গতবছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেবা প্রদানে চুক্তিবদ্ধ ছিল। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে উক্ত জনবল কর্মে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় আন্তঃখাত সমন্বয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন ও অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনুমোদন না থাকায় এবং ১ জানুয়ারি হতে কর্মে অনুপস্থিত থাকায় উল্লিখিত প্রকল্পের জনবলের চুক্তির মেয়াদ নতুনভাবে বাড়ানো এবং রাজস্ব অংশের অব্যয়িত অর্থ থেকে সেবামূল্য পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, আপাতত এসব জনবল আমাদের প্রয়োজন না থাকায় চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন