গত ২৮ মে থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুই দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন তথ্য আপা প্রকল্পের কর্মীরা। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—প্রকল্পের মেয়াদ শেষে কর্মীদের নিজস্ব জনবল হিসেবে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর এবং কর্তনকৃত বেতন-ভাতা পরিশোধ। দাবি আদায় না হওয়ায় ঈদের ছুটিতেও আন্দোলন চালিয়েছেন তারা।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কর্মীদের দাবিগুলো পূরণে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাতে সহযোগিতা করছেন না। অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতির অভিযোগ আড়াল করতেই তারা এমনটা করছেন।
চলতি মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে আগামী ৩০ জুন ইউএনও কার্যালয় কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসায় নেওয়া অফিস ভাড়া ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রকল্পের জন্য কেনা গাড়ি, আসবাব, কম্পিউটার এবং স্বাস্থ্যসেবা ডিভাইসসহ অন্য সরঞ্জামাদি জাতীয় মহিলা সংস্থার কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হলেও, কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
প্রকল্পের জনবল কাঠামো অনুযায়ী, দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়োজিত কর্মীদের প্রকল্প শেষে সমমানের পদে জাতীয় মহিলা সংস্থা বা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পদায়ন/স্থায়ীকরণ অথবা পদ সৃজন করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে, যাতে উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে প্রয়োজনীয় পদ সৃজন ও জনবল নিয়োগের নির্দেশনা ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প পরিচালকের কাছে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশ পাঠানো হয়।
কর্মীরা অভিযোগ করেন, সরকারের এই উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তারা রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে কোনো আগ্রহ দেখাননি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় জনবল প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই বছর পূর্বেই অনুমোদনের জন্য পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু প্রকল্পের পক্ষ থেকে বলা হয়, শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেও এই কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব।
২০২০ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন-১ অধিশাখা থেকে পাঠানো এক পত্রে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের জনবলকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির সময় আইনগত শর্তাবলি মেনে চলতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী তারা বয়সে ছাড় পেতে পারেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ৭ম সভায় মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্থায়ী পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু কোনো সুপারিশই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ।
প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত বেতন কাঠামো অনুসারে কর্মীদের ১০ম গ্রেডে ২৭,১০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও, অনেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে ২৪,৭০০ টাকা। বেতন কর্তনের পেছনে ২০১৬ সালের একটি পরিপত্র দেখানো হলেও, ২০১৮ সালের বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগপত্রে বেতন হ্রাসের কোনো উল্লেখ ছিল না।
তথ্যসেবা সহকারীদের বেতনও ১৭,০৪৫ টাকার স্থলে দেওয়া হচ্ছে ১৫,৬৫০ টাকা। কর্মীদের দাবি, সরকার বেতন কাঠামোর যুক্তি দিলেও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য প্রকল্পে তা প্রযোজ্য নয়, ফলে তারা বৈষম্যের শিকার।
২০২৩ সালে এই বেতন বৈষম্য ও রাজস্ব খাতে স্থানান্তর সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। আদালত চার সপ্তাহের মধ্যে সরকারের জবাব চায় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
গত বছরের আগস্টে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের দাবিতে কর্মীরা আন্দোলন করলে তৎকালীন মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব মৌখিকভাবে দাবি মানার আশ্বাস দেন। তবে তার পরিবর্তে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তারপর চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ আন্দোলনরত কর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বসেন। সেখানে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে মৌখিকভাবে জানান। এমনকি তাদের কোথাও পুনর্বাসন করা যায় কি না, তাও দেখার আশ্বাস দেন।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে কর্মীদের মূল্যায়ন করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সুপারিশ পাঠানো হয়। এরপর মার্চে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হলেও এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার তথ্যসেবা কর্মকর্তা সঙ্গীতা সরকার বলেন, ‘প্রকল্প কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে না। তারা নিজেদের প্রয়োজনে প্রকল্প নিয়েছেন, আবার এখন নিজেদের স্বার্থে বন্ধ করতে চাচ্ছেন। বর্তমান জনবলকে স্থায়ী না করে তৃতীয় পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে তাদের নিয়োগ বাণিজ্য করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তথ্যসেবা কর্মকর্তা সুমাইয়া ইয়াসমিন বলেন, ‘সরকার থেকে বারবার সুপারিশের কথা বলা হলেও সদর দপ্তরের অনীহার কারণেই তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সঙ্গে যেন ছেলেখেলা করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে তথ্য আপা প্রকল্পের পরিচালক শাহনাজ বেগম নীনার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন