শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২
রাফসান জানি
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিয়ামে আগুনের মূল নির্দেশদাতা নিয়ে ধোঁয়াশা

১০-১২ লাখ টাকায় চুক্তি
বিয়ামে আগুনের মূল নির্দেশদাতা নিয়ে ধোঁয়াশা

রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনের একটি অফিস কক্ষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে আগুন লাগার ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়। তাদের একজন অফিস সহায়ক ও একজন গাড়িচালক। সে সময় ফায়ার সার্ভিস বলেছিল, এসি বিস্ফোরণ থেকে এই আগুনের সূত্রপাত। তবে ঘটনার পাঁচ মাস পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে উঠে এসেছে, বিয়ামে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছিল। যে দুজন এই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, তারাও এই পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন।

পিবিআইর স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিট (এসআইঅ্যান্ডও) প্রায় তিন মাস তদন্ত করে জানতে পেরেছে, আগুন লাগিয়ে নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার জন্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার চুক্তি হয়। পিবিআই আগুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও পরে গ্রেপ্তার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মো. আশরাফুল ইসলাম (৩৬)। গত ২৫ জুলাই তাদের কুড়িগ্রাম ও ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পিবিআই বলেছে, আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই ছিলেন। আর বাসায় বসে ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখছিলেন বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম।

গ্রেপ্তারের পর দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দির বরাতে পিবিআই জানিয়েছে, বিয়াম ভবনের ৫০৪ নম্বর কক্ষের সব নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার জন্য আগুনের পরিকল্পনা করা হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের কথামতো বাকি তিনজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী নথিগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিতে যান; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পুরো কক্ষে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিলে এসি বিস্ফোরিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান অফিস সহকারী আব্দুল মালেক। গাড়িচালক মো. ফারুক গুরুতর আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। তবে মাস্টারমাইন্ড জাহিদুল কার কাছ থেকে এমন নির্দেশনা পেয়েছেন, জবানবন্দিতে তিনি সে বিষয়ে কিছু বলেননি। এ কারণে সেই নির্দেশদাতার নাম এবং কেন নথি পোড়ানো হয়েছে, সে সম্পর্কে রহস্য থেকেই যাচ্ছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আগুনের পর ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. মশিউর রহমান। থানা পুলিশ কয়েক মাস তদন্ত করে কোনো কূলকিনারা করতে না পারায় গত মে মাসের শুরুতে মামলাটি পিবিআইর এসআইঅ্যান্ডও বিভাগকে তদন্তভার দেওয়া হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল নির্দেশদাতা কে বা কার স্বার্থে এই আগুন—এমন প্রশ্নে বেশ কয়েকটি বিষয় তাদের সামনে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে, দেশের একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে বিয়ামের জমি সংক্রান্ত বিরোধ। কয়েক বিঘা জমির দলিল ছিল ৫০৪ নম্বর কক্ষে। এটি একটি কারণ হতে পারে। বর্তমান কমিটির সঙ্গে সাবেক কমিটির ঝামেলা চলছিল। কক্ষটিতে ছিল বেশ কিছু পে-অর্ডার। এগুলো ছাড়াও ওই কক্ষে নগদ টাকাও ছিল বলে জানা গেছে।

প্রাথমিক তদন্তে, ৫০৪ নম্বর কক্ষে রাখা সমিতির দলিলপত্র, নামজারি সংক্রান্ত কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাবের চেকবই, জমি ক্রয়-সংক্রান্ত চারটি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র কক্ষের এসি ইত্যাদিসহ অন্যান্য মালপত্র সব পুড়ে গেছে।

তবে পুড়ে যাওয়া এই তালিকা নিয়ে সন্তুষ্ট নন তদন্ত কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ঘটনার সঙ্গে যখন খোদ প্রশাসনিক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, সেখানে আরও তথ্য গোপন করা হতে পারে। সেজন্য দেশের একটি বড় অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব বিষয় সামনে এসেছে, সেগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।

যেভাবে দেওয়া হয় আগুন: গ্রেপ্তার দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাতে গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছে পিবিআই। দক্ষিণ কল্যাণপুরে পিবিআই এসআইঅ্যান্ডওর (উত্তর) অফিসে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান।

চাঞ্চল্যকর এই মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য একাধিক বিশেষায়িত টিম গঠন করা হয়। বিশেষায়িত টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময়ের সংগ্রহকৃত সিসিটিভি ফুটেজে বিশ্লেষণে জানতে পারে, ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরা ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন যুবকের উপস্থিতি দেখা যায়। বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় চলে যায় এবং সিসিটিভি বন্ধ করে দেয়। পিবিআইর বিশেষায়িত টিম এআইর মাধ্যমে আসামির ছবি শনাক্ত করে। এর পর তারা গত ২৫ জুলাই আত্মগোপনে থাকা আশরাফুল ইসলামকে কুড়িগ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামকে একই দিন ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পিবিআইর জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ইসলাম জানান, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস এম জাহিদুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল ইসলাম তাকে গত বছরের ৫ আগস্টের ঘটনার ২-৩ মাস আগে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা ৫-৬ মাস রাখেন। জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে তিনি প্রায়ই বিয়াম প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতেন। ওই অফিসের কয়েকজনের সঙ্গে তার সুসম্পর্কও তৈরি হয়। সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংস করার জন্য বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম, অফিস সহায়ক আব্দুল মালেক, ড্রাইভার ফারুক ও তিনি নিজে মিলে পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষে তাদের ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়।

পিবিআই জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের ৫ম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে জাহিদ। সেই টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ডগ্লাভস ও ফুল স্লিপ শার্ট কেনেন। আর পেট্রোল কেনেন ড্রাইভার ফারুক। ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ডগ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের ৫ম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অফিস সহায়ক মালেক ও ড্রাইভার ফারুক ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে ড্রাইভার মালেক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। আশরাফুল তখন ৫ম তলা থেকে ৩য় তলা নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক মালেক মারা যান। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এলে আশরাফুল কৌশলে হোটেল রুমে চলে যান।

ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ামে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসেন জাহিদুল ইসলাম। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান। প্রথম দিন ফারুকের পাশে হাসপাতালে আশরাফুলই ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফারুক মারা গেলে এবং ঘটনা নিয়ে নড়াচড়া শুরু হলে আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে জাহিদ তাকে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে বলেন।

পিবিআইয়ে বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান বলেন, জাহিদের কথা মতো পরদিন আশরাফুল রংপুর চলে যান। এই কাজে আশরাফুলকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও জাহিদ এখন পর্যন্ত তাকে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১০

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

১১

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

১২

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

১৩

এএসপির বাসায় চাঁদাবাজি-ভাঙচুর, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৪

জেলের জালে বড় ইলিশ, ৯ হাজারে বিক্রি 

১৫

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন নিয়ে নতুন নির্দেশনা

১৬

আগামী সংসদ প্রথম তিন মাস ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব

১৭

ধরলার তীব্র ভাঙন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি

১৮

নেতা ও ভোটারের জবাবদিহিই হবে শ্রেষ্ঠ সংস্কার : মঈন খান

১৯

পাপের ফল ওদের ভোগ করতেই হবে : রাশেদ খান

২০
X