মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারি ১০ হাসপাতালেই ৮০ শতাংশ মৃত্যু

ডেঙ্গু সংক্রমণ
সরকারি ১০ হাসপাতালেই ৮০ শতাংশ মৃত্যু

ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, সারা বছরই সংক্রমণ চলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশক নিধনে ব্যর্থতা এবং জনসচেতনতার ঘাটতির কারণে ডেঙ্গু জ্বর এখন বছরজুড়ে ভোগান্তির নাম। দুই যুগের বেশি সময় ধরে জেঁকে বসা এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দাঁড়ায়নি; ফলে প্রতি বছর শনাক্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। গত ১০ মাসে রোগীর চাপ এতটা বেড়েছে যে, গত ২৫ বছরের মধ্যে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি চতুর্থ সর্বোচ্চ। সামনে আরও দুই মাস মশার উপদ্রব থাকবে—শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা আছে।

চলতি মৌসুমে শনাক্ত ৬৩ হাজার ৬৩৮ ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত ২৫৯ জনের মধ্যে ১০টি সরকারি হাসপাতালে ছিল সবচেয়ে বেশি রোগীর ভিড়; মৃত্যুও সেখানে বেশি। মোট মৃত ২৫৯ জনের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি মারা গেছেন ওই ১০ হাসপাতালে। এর মধ্যে রাজধানীর ৫ হাসপাতালে রোগীর ঢল ও মৃত্যুও সর্বোচ্চ। বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র দেখা গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, ডেঙ্গু এখন আর বর্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বছরজুড়েই শনাক্ত হচ্ছে এবং হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে; আনুপাতিকভাবে মৃত্যুও হচ্ছে বছরজুড়ে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরও রোগটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল কারণ অবহেলা ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার অভাব। শুরুতে ডেঙ্গু রাজধানীকেন্দ্রিক থাকলেও ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়েছে; এখন রাজধানীর বাইরেই রোগীর চাপ বেশি—বরিশাল, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে চাপ তুলনামূলক বেশি। মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ালেই ডেঙ্গু থেকে মুক্তি মিলতে পারে।

২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বছরওয়ারি হিসাবে চলতি বছর শনাক্ত রোগীর সংখ্যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ভর্তি হন, ২০২৪ সালে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন, ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন ও ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ভর্তি হয়েছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ২৫৯ জন। এর মধ্যে দেশের ১০ হাসপাতালে মারা গেছেন ২১৪ জন। হাসপাতালভিত্তিক মৃত্যুর চিত্র—ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৫ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৭, বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কভিড হাসপাতালে ১৮, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৫, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১৩, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮ জন।

ভর্তির বিস্তারিত: এ বছর মোট ডেঙ্গু রোগী ৬৩ হাজার ৬৩৮ জন; এর মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশের ১০ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ১৮ হাজার ৪১৬ জন (২৮.৯৩ শতাংশ)। সর্বোচ্চ ভর্তি মহাখালীর ডিএনসিসি কভিড হাসপাতালে ২ হাজার ৮৮৪ জন—সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন ২ হাজার ৭২২ জন, মারা গেছেন ১৮ জন ও চিকিৎসাধীন ১৪৪ জন। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ৫৫৪ জন—ছাড়পত্র ২ হাজার ৩৬১ জন, মৃত্যু ৩৭ ও চিকিৎসাধীন ১৫৬ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ৫০৩ জন—ছাড়পত্র ২ হাজার ২৭৬ জন, মৃত্যু ৬৫ ও চিকিৎসাধীন ১৬২ জন। গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ২ হাজার ২৯২ জন—ছাড়পত্র ২ হাজার ১৫৯ জন, মৃত্যু ১ ও ভর্তি ১৩২ জন। বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ৭৫৭ জন—ছাড়পত্র ১ হাজার ৬৪৭ জন, মৃত্যু ২২ ও চিকিৎসাধীন ৮৮ জন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ৫৭৭ জন—ছাড়পত্র ১ হাজার ৪৯১ জন, মৃত্যু ১৩ ও চিকিৎসাধীন ৭৩ জন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ৩৩৮ জন—ছাড়পত্র ১ হাজার ২৭২ জন, মৃত্যু ১৫ ও চিকিৎসাধীন ৫১ জন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২২৩ জন—ছাড়পত্র ১ হাজার ১৮২ জন, মৃত্যু ১৫ ও ভর্তি ২৬ জন। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ১৮৬ জন—ছাড়পত্র ১ হাজার ১৬৭ জন ও ভর্তি ১৯। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ১০২ জন—ছাড়পত্র ১ হাজার ১৩ জন, মৃত্যু ১০ ও ভর্তি ৭৯ জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণের অন্যতম কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। থেমে থেমে বৃষ্টিতে শহরে পানি জমে থাকে; অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নালা-নর্দমার অব্যবস্থাপনা মশার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে। সচেতনতার অভাবও বড় কারণ—যেখানে-সেখানে আবর্জনা, পলিথিন, বোতলে পানি জমে থাকে; পাশের বাসায় কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও নিজেদের ঝুঁকি ভাবি না। কমিউনিটি উদ্যোগও দুর্বল—বহু ভবনের নিচে পানি জমে থাকে, কেউ খোঁজ নেয় না।’

সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রথম কাজ লার্ভা ধ্বংস। তাই লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড—দুই স্তরেই উপযুক্ত সময়ে কাজ করতে হবে। নীতিমালা আছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও আছে; কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। রাষ্ট্র যদি করোনা মহামারির মতো ডেঙ্গুকেও ‘এক নম্বর অগ্রাধিকার’ দেয়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অথচ মৌসুমে কিছু ফগার চালানো, কিছু ওষুধ ছিটানো—এ ‘আইওয়াশ’ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার মূল কারণ। ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা, মশার রেজিস্ট্যান্স যাচাই—এসবও নিয়মিত হওয়া দরকার; ওষুধ আমদানিতে সিন্ডিকেট থাকলে সময়মতো কার্যকর ওষুধ আসে না।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গতকাল দেশে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি। একই সময়ে নতুন ভর্তি ৪৬৪ জন—বরিশাল বিভাগে (সিটি এলাকার বাইরে) ৭৩, চট্টগ্রামে ৮৭, ঢাকা বিভাগে (সিটি এলাকার বাইরে) ১০৪, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১১১, দক্ষিণ সিটিতে ৪৭, খুলনায় ১৩ এবং ময়মনসিংহে ৩৩ জন। একই সময়ে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪৭৪ জন। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬৩ হাজার ৬৩৮ জন হাসপাতালে ভর্তি; পুরুষ ৬১.৬ শতাংশ, নারী ৩৮.৪ শতাংশ; মৃত্যু ২৫৯ জন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মৃত্যুর পরও যে ৩ আমলের সওয়াব বান্দার আমলনামায় যোগ হতে থাকে

২৬ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

অভিজ্ঞতা ছাড়াই আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে চাকরি, দ্রুত আবেদন করুন

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ৭ম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

কানাডার ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের

আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেটরিন কনলির ভূমিধস জয়

সাফ অ্যাথলেটিক্সে বাংলাদেশের ব্রোঞ্জ পদক জয়

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাসপোর্ট ফি কমাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার

বিসিবির কাছে বিচার চেয়ে সোহাগ গাজীর চিঠি

এগিয়ে গিয়েও ব্যর্থতার হতাশায় পুড়ল বসুন্ধরা কিংস

১০

বিচ্ছেদ গুঞ্জনে যা বললেন পূর্ণিমা

১১

এমবেউমোর জোড়া গোলে ম্যানইউর টানা তৃতীয় জয়

১২

পুরান ঢাকায় বাসার সিঁড়িতে আবারও এক শিক্ষার্থীর লাশ!

১৩

জেন-জির বিক্ষোভে দেশ ছেড়ে পালানো প্রেসিডেন্টের নাগরিকত্ব বাতিল

১৪

নতুন সরকার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে থাকবেন কি না, জানালেন ধর্ম উপদেষ্টা

১৫

ভুটান সরকারের ‘পাখিবাড়ি’

১৬

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে না দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ

১৭

আ.লীগ নেতার কবর জিয়ারত করলেন জামায়াতের এমপি প্রার্থী

১৮

দুর্ঘটনার কয়েক মাস আগে থেকেই ‘শাহাদাতের’দোয়া পড়ছিলেন জুনায়েদ জামশেদ

১৯

বিএনপি নেতাকে দেওয়া মালায় ১০ লাখ টাকার চেক

২০
X