

আট বছর আগে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম নিয়োগ নিয়ে গুরুতর বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। পছন্দের লোককে নিয়োগ পাইয়ে দিতে সরকারি আদেশ এবং সুপ্রিম কোর্টের নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফায় প্রধান বিচারপতির কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু সেই অভিযোগের ভিত্তিতে এ ঘটনার তদন্তে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এই অভিযোগের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার এ এইচ এম তোহা কালবেলাকে বলেন, এরকম একটা অভিযোগের কথা শুনেছি। তবে তদন্তের ব্যাপারে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কি না, সেটা রেজিস্ট্রার জেনারেল বলতে পারেন।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম পদটি সৃজন করা হয়। ওই মসজিদের ইমাম পদ সৃজনের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে কামিল অথবা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়/ সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম শিক্ষা বা আরবিতে স্নাতক ডিগ্রিসহ কোরআনে হাফেজ থাকার শর্ত আরোপ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই যোগ্যতার ব্যত্যয় ঘটলে বেতন স্কেল কার্যকর করা যাবে না বলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শর্তে উল্লেখ করা হয়।
সেই শর্তানুসারে সুপ্রিম কোর্টের নিয়োগবিধিতেও ইমাম পদের অনুরূপ যোগ্যতার উল্লেখ আছে। তবে ২০১৭ সালে পছন্দের লোক নিয়োগ করার উদ্দেশ্যে ইমাম পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিধি লঙ্ঘন করে নতুন একটি শিক্ষাগত যোগ্যতা যোগ করা হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে কামিল অথবা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়/ সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম শিক্ষা বা আরবিতে স্নাতক ডিগ্রিসহ কোরআনে হাফেজ থাকার পাশাপাশি দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিধারীরাও বর্ণিত পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মূল নিয়োগবিধি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশে দাওরায়ে হাদিসের ডিগ্রিধারীদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়নি। কৌশলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দাওরায়ে হাদিস যুক্ত করে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিধারী মো. মাসুম বিল্লাহকে সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোনো পদের যোগ্যতা সংযোজন বা সংশোধনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব প্রেরণ, মন্ত্রণালয়ের সম্মতি গ্রহণ এবং নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় অনুমোদন প্রত্যাবর্তন বাধ্যতামূলক। তবে সংশ্লিষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এ ধরনের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শুধু পছন্দের লোককে নিয়োগ পাইয়ে দিতে ২০১৭ সালে জারি করা ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে অবৈধভাবে যোগ্যতা হিসেবে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি যুক্ত করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই এভাবে নিয়োগবিধির ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়োগ দেওয়ার পর পরই তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনাও তৈরি হয়। এরপর নিয়োগপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক দপ্তরে ধরনা দেন; কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। ওই পদের নিয়োগপ্রত্যাশীরা, নিয়োগের পর বেশ কয়েক দফায় প্রধান বিচারপতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। সবশেষ গত ২৩ নভেম্বর ওই পদের নিয়োগপ্রত্যাশী মো. নুরুল আলম প্রধান বিচারপতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন এবং সংবাদ সম্মেলন করেন।
লিখিত অভিযোগে নুরুল আলম উল্লেখ করেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘দাওরায়ে হাদিস’ নামে যে অতিরিক্ত যোগ্যতা যুক্ত করা হয়েছিল, তা সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অনুমোদন ব্যতীত এবং সাধারণ ও সংস্থাপন শাখার তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্টের মাধ্যমে সম্পূর্ণ জালিয়াতিপূর্বক প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেটা সংযোজন করা হয়। অন্যদিকে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি ২০১৩ সালের একটি দাওরায়ে হাদিস সনদ দাখিল করেন, যা সেই সময় মাস্টার্সের সমমান ছিল না। তদুপরি, ওই পদে সরকার নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার তালিকা এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট নিয়োগবিধিতে বিদ্যমান যোগ্যতার তালিকায় দাওরায়ে হাদিস অন্তর্ভুক্তই ছিল না। সুতরাং এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশাসনিক দুর্নীতি ও প্রতারণা, যা শুধু রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অবমাননা নয়; বরং একটি যোগ্য ও প্রকৃত প্রার্থীর অধিকার হরণের শামিল। আবেদনে বিষয়টি নিরপেক্ষ, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও কার্যকর তদন্তের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে আইন ও বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে নুরুল আলম গতকাল সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে ইমাম নিয়োগের পরপরই আমি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে অভিযোগ দাখিল করি। এরপর ২০২৩ সালে এবং সর্বশেষ গত নভেম্বরে অভিযোগ দাখিল করেছি। কিন্তু প্রশাসন এখন পর্যন্ত এই অনিয়ম তদন্তে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’
মন্তব্য করুন