এইডস আক্রান্ত হয়েও সুস্থ সন্তান জন্মদান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশের এইডস আক্রান্ত নারী ও পুরুষ ২৭০টি সন্তানের মা-বাবা হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫৯ নবজাতক এইচআইভিমুক্ত ছিল। এইডস চিকিৎসায় সারা দেশে ১৩টি অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারে আসা রোগীরা এই সফলতা পেয়েছেন। ফলে রোগটি প্রতিরোধে ব্যাপক ভিত্তিতে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি দ্রুত রোগী শনাক্ত করে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এইডস সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে আজ শুক্রবার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস-২০২৩। এবারের প্রতিপাদ্য লেটস কমিউনিটিস লিড অর্থাৎ কমিউনিটির আমন্ত্রণ, এইডস হবে নিয়ন্ত্রণ। দিবসটি উপলক্ষে আসিডিডিআর,বি, কেয়ার বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বেসরকারি সংস্থাগুলো সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক-তৃতীয়ংশ এইডস পজিটিভ মা তিনভাবে সন্তানের দেহে ভাইরাসটি ছড়ান। এর মধ্যে গর্ভকাল থেকে প্রসব-পূর্ব সময়ে ১ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত ছড়াতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় ছড়াতে পারে ৮ শতাংশ। শিশুর জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে ৭ শতাংশ আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে ৬ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে ৩ শতাংশ শিশু। তবে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও সঠিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ সন্তান জন্ম দিচ্ছেন এইডস রোগীরা। সঠিক নিয়মে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ সন্তান প্রসবে সফলতার হার প্রায় ৯৮ শতাংশ।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে প্রতিবছর যে সংখ্যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তার ৫০ শতাংশই প্রবাসী।
অন্তঃসত্ত্বা রয়েছেন শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
মরণ ব্যাধি এইচআইভি এইডসে বর্তমানে অনুমিত রোগী ১৪ হাজার ৬০০ জন। তবে ১৯৮৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এইডস শনাক্ত হওয়া চিহ্নিত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৭০৮। এ সময়ে মারা গেছেন এক হাজার ৮২০ জন। বর্তমানে জনসাধারণের মধ্যে রোগটি প্রার্দুভাবের হার শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশের কম।
এইডস পজিটিভ গর্ভবতীদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১৩ সাল থেকে ইউনিসেফের সহযোগিতায় প্রেগ্যিান্ট মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন প্রোগ্রাম (পিএমটিসিটি) কার্যক্রম চালু করে। বর্তমানে ইউনিসেফের কর্মসূচি বন্ধ থাকলেও সরকারিভাবে পরিচালিত কেন্দ্রে আসা রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শে এই সেবা নিতে পারছেন। এসব কেন্দ্রের মধ্যে বিএসএমএমইউ, পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যশোর জেলা সদর হাসপাতাল এবং কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালসহ উখিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে এই কার্যক্রম আছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা আগামী ২০২৫ সাল। এ সময়ের মধ্যে রোগটির প্রতিরোধ সম্পর্কে ৯৫ ভাগ মানুষকে সচেতন করতে হবে। শনাক্ত হওয়া ৯৫ শতাংশ রোগীকে এআরটি সেন্টারে মাধ্যমে চিকিৎসা আওতায় আনতে হবে। ৯৫ ভাগ এআরটি সেবাগ্রহীতা রোগীর দেহে ভাইরাল লোড ৫০ কপি প্রতি মিলিলিটারে নিচে আনতে হবে। এই তিনটি ৯৫ অর্জন সম্ভব হলে রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, এইডস আক্রান্ত কোনো পুরুষ বা নারী চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সঠিক নিয়মে ওষুধ খেলে একটা সময় তার রক্তে এইচআইভি ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকে না। এতে আক্রান্ত স্বামীর শুক্রাণুর মাধ্যমে যে পরিমাণ ভাইরাস স্ত্রীর দেহে প্রবেশ করলে স্ত্রীও পজিটিভ হবে, স্বামী নিয়মিত এইডসের বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ সেবনের ফলে রক্তে এবং শুক্রাণুতে সেই পরিমাণ ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকে না। একইভাবে এইডস আক্রান্ত নারীর থেকে গর্ভের সন্তানের শরীরে যতটুকু পরিমাণ ভাইরাস যাওয়ার দরকার, ওই নারী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ নিয়মিত সেবনের ফলে রক্তে ভাইরাসটির অস্তিত্ব থাকে না। তখন তার গর্ভস্থ শিশু এইডস ছাড়াই জন্ম নিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পজিটিভ ব্যক্তির রক্তে এইচআইভির ভাইরাল লোড তথা ভাইরাসের মাত্রা অবশ্যই প্রতি মিলিলিটারে ৫০ কপির (সংখ্যা) নিচে থাকতে হবে। এইচআইভি রোগীর শরীরে ভাইরাল লোড এক হাজারের ওপরে থাকলে পরিস্থিতি খারাপ ধরা হয়।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি সিনিয়র ম্যানেজার মো. আখতারুজ্জামানের মতে ৫টি হাসপাতাল বা ১৩টি এরআরটি সেন্টারের মাধ্যমে মা থেকে শিশুর এইডস সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে এবং বেসরকারি হাসাপাতালে এই সেবা চালু করতে হবে। এসব কেন্দ্রে মা থেকে সন্তানকে এইডস মুক্ত রাখাতে গর্ভধারণের পূর্বে এইচআইভি পরীক্ষা করতে হবে। আক্রান্ত গর্ভবতী নারীকে গর্ভধারণের আগে থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ সেবন করতে হবে। সুস্থ সন্তান জন্মদানে নিরাপদ ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে জোড় দিতে হবে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের ম্যানেজার (ডাটা ও আইটি) মো. আলাউদ্দীন চৌধুরী বলেন, দেশে ২৩ জেলায় সরকারিভাবে পরিচালিত এইচআইভি পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে ১৩টি এআরটি সেন্টার রয়েছে। এইচআইভি পরীক্ষাকেন্দ্র আছে ১০টি। এ ছাড়া ৯টি কারাগারে এইডস শনাক্ত ও পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ), গাজিপুরের কাশিমপুর কারাগার-১ ও ২, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী, কুমিল্লা ও যশোর জেলখানায় এই সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবে পরিচালিত ১১৫টি ড্রপ ইন সেন্টার রয়েছে। যেখানে সন্দেহভাজনদের বিনামূল্যে এইডস শনাক্তকরণ, চিকিৎসা প্রদান, ওষুধ ও ভাইরাস প্রতিরোধী উপকরণ সরবারহ করা হয়। গত বছরের শেষের দিকে আরও ৯টি জেলায় এইচআইভি প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে নিয়মিত কাউন্সেলিং, পরীক্ষা, চিকিৎসা, ওষুধ ও উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে।