‘আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব;/ শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;’—সত্যি তার কবিতার পঙক্তির মতো এ তল্লাটে একটু থেমে আবার এগিয়ে গেছেন আমাদের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সেই একটু দাঁড়িয়েই আমাদের শিল্প-সাহিত্যের পরিসরকে আলোকিত করে তিনি যেন নিজের গন্তব্যে এগিয়ে গেলেন। লেখার ক্ষেত্রে সব্যসাচী অনেকেই আছেন, কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্বের মতোই লেখার প্রাবল্যে, শক্তিমত্তায়, বৈচিত্র্যে ও দৃঢ়তায় সৈয়দ হক তার নিজের নামের সঙ্গে যেন অনিবার্যভাবে অধিকার করে নিয়েছেন ‘সব্যসাচী’ অভিধাটিকে। আজ তার ৮৯তম জন্মদিন।
ছয় দশকেরও বেশি সময়ের লেখকজীবনে বহুমাত্রিক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এ বরেণ্য সাহিত্যিক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সব শাখায় যুগপৎ সক্রিয়তাই তাকে সব্যসাচী লেখকে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ, অনুভূতি, বিদ্বেষ, বিদ্রোহ ও গৌরব সবই কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তার লেখনীতে। সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। ১৯৫১ সালে ‘অগত্যা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে তার প্রথম প্রকাশিত লেখাটি ছিল একটি গল্প। এরপর তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে। ১৯৬৬ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সৈয়দ শামসুল হক স্কুলজীবন শেষ করেন কুড়িগ্রামে। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। বাবার এ চাওয়া এড়াতে ১৯৫১ সালে মুম্বাইয়ে পালিয়েছিলেন তিনি। মুম্বাইয়ে গিয়ে কিছুদিন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তার রচিত কাব্যগ্রন্থ, বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা। আধুনিক সময়ে কোনো কবির এত দীর্ঘ কবিতা বেশ বিরল। তার এ কাব্যগ্রন্থের কারণে তিনি তখন আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। তার আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পরানের গহীন ভিতর’ দিয়ে তিনি তার কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং শিল্পনৈপুণ্যে উজ্জ্বল করে উপস্থাপন করেছেন। নাট্যকার হিসেবে তার কাজের সূচনাটি হয়েছিল বিবিসি বাংলায় নাটক করার অভিজ্ঞতা থেকেই। নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন দারুণ সফল। বিশেষ করে তার রচিত দুটি কাব্যনাট্য ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ ও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে।
সৈয়দ হকের ভাষা আর আঙ্গিকের উজ্জ্বল নিরীক্ষার পরিচয় উৎকীর্ণ হয়ে আছে ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘অপর পুরুষ’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। তার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নীল দংশন’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘তুমি সেই তরবারি’ ও ‘নিষিদ্ধ লোবান’।
ছোটদের জন্য লেখা ‘সীমান্তে সিংহাসন’, ‘আবু বড় হয়’ ও ‘হাডসনের বন্ধু’ পেয়েছে বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। তার অতুলনীয় কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ ইত্যাদি। ম্যাকবেথসহ বিশ্বসাহিত্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাও বাংলায় অনুবাদ করেছেন তিনি।
২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে তাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেন। চার মাস চিকিৎসার পর ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলা একাডেমি ও আদমজী পুরস্কার ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার, লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক, পদাবলি কবিতা পুরস্কার, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, টেনাশিনাস পদক, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার।
সৈয়দ শামসুল হকের এবারের জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এরই মধ্যে তাকে নিয়ে বিভিন্ন রচনা প্রকাশের পাশাপাশি কয়েকটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—১৯৬৩ সালে লেখা উপন্যাসিকা ‘জনক ও কালো কফি’, তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, উপন্যাস ‘বুকঝিম এক ভালোবাসা’।
তার সহধর্মিণী কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক জানান, জন্মদিন উপলক্ষে সৈয়দ শামসুল হক স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে কুড়িগ্রামে আয়োজন করা হয়েছে সৈয়দ শামসুল হক মেলা ২০২৩। কুড়িগ্রামে আজ সকালে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে এবং কবিকে নিয়ে থাকবে সাহিত্য আড্ডা ও আলোচনার আয়োজন।