দুপুরের পরই টিএসসি থেকে শুরু করে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ছিল উৎসবের আমেজ। এই উৎসবের উপলক্ষ অমর একুশে বইমেলা। উদ্বোধনের পর বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের জন্য প্রাণের এ মেলার দ্বার খোলে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। বিকেলটা মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও মেলায় আনাগোনা ছিল মানুষের। কিন্তু সেই আমেজে ভাটা পড়ে সন্ধ্যায় প্রবল বৃষ্টি নামলে।
বইমেলার প্রথম দিন গতকাল বৃহস্পতিবার পাঠক ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম ছিল। যারা এসেছিলেন, তারাও বৃষ্টির কারণে ভোগান্তিতে পড়েন। প্রবল বৃষ্টিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বেশ কয়েকটি স্টলসহ বই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে এদিন বিক্রিও তেমন ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বিকেলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করেন। পরে সবার জন্য খুলে দেওয়া হয় মেলা প্রাঙ্গণ।
বৃষ্টির আগে সরেজমিন বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টির আগে কিছু স্টলে কয়েকজন বই উল্টেপাল্টে দেখছেন, কেউ কিনছেন। তবে বেশিরভাগই দেখে রেখে যাচ্ছেন। মেলার প্রথম দিন বলে বিক্রির চাপ না থাকায় স্টল গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন বিক্রয়কর্মীরা। মালিকপক্ষ ও প্রকাশনার লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে তদারকির পাশাপাশি দিচ্ছিলেন বিভিন্ন নির্দেশনা।
মেলার প্রথম দিনে দর্শক গত বছরগুলোর তুলনায় কম ছিল বলে জানিয়েছেন প্রকাশনা সংস্থার প্রতিনিধিরা। তবে বই বিক্রি এবার আগের বছরের তুলনায় বাড়তে পারে বলে তাদের বিশ্বাস। বিক্রয় কর্মীরা মনে করেন, বইয়ের দাম বাড়ার কারণে বিক্রিতে কিছুটা টান লাগতে পারে। কিন্তু খুব একটা কমবে না। কেননা, পাঠকের কাছে বই পড়ার আনন্দের চাইতে আর বড় কিছু নেই।
আদর্শ প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী পৃথ্বীলা দাস বলেন, মেলার প্রথম দিন পাঠক-দর্শক ভালোই আগের বছরগুলোর তুলনায়। আজকে প্রথম দিন দর্শক চাপ কম, ক্রেতা কম, আর তাই এ সময়টায় স্টলে বই গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছি। দু-একজন ক্রেতা এলে তাদের সঙ্গে কথা বলছি।
কিংবদন্তি প্রকাশনীর প্রকাশক অঞ্জন হাসান পবণ বলেন, এবার বইমেলা নিয়ে আমরা বেশ আশাবাদী। মেট্রোরেল চলছে, যানজটের ঝামেলা নেই। উত্তরা-মিরপুর থেকে মানুষ আসবে নিয়মিত। বই বিক্রিও বাড়বে। তিনি বলেন, আমাদের প্রকাশনা থেকে মোট ৩৪টি নতুন বই প্রকাশ করছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জল্লাদ শাহজাহানের ‘কেমন ছিল জল্লাদজীবন’।
মেলায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে বৃষ্টির তীব্রতা বাড়লে দিব্য প্রকাশনীসহ বেশ কয়েকটি স্টল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে স্টল ব্যবস্থাপক সোহাগ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে আমাদের দুই শতাধিক বই নষ্ট হয়েছে। ছাউনি না থাকায় অর্ধশতাধিক মানুষ বৃষ্টিতে ভিজেছেন।
মেলায় আগত পাঠক এম আর লিটন বলেন, একুশে বইমেলা বাঙালির চেতনা ও আবেগের সঙ্গে জড়িত। বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য, তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে। বইমেলা ওই জাগরণের কথাই তুলে ধরে। আজ যারা মেলায় এসেছেন, বৃষ্টির কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
লেখক ও গল্পকার মনি হায়দার বলেন, প্রথম দিন লোকসমাগম কম, কিন্তু বৃষ্টি না থাকলে পাঠক-সমাবেশ বেশ চোখে পড়ার মতো হতে পারত।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, প্রকাশকরা বই প্রস্তুতকরণে ব্যস্ত থাকে ফেব্রুয়ারির ১-৫ তারিখ পর্যন্ত। আসলে এ কারণে প্রকাশনাগুলো তাদের স্টল প্রস্তুত করতে পারেনি। বৃষ্টির কারণে মেলার মাঠে যেন পানি জমে না থাকে। সে বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে জানানো হয়েছে, যাতে মাঠে বালু ফেলা হয়।
এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা। মেলার বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। তবে আঙ্গিকগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গত বছরের মতো শিশু চত্বর মন্দির গেটে প্রবেশের ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে।
মেলায় এবার প্রকাশনা সংস্থা বাড়ছে। গত বছর যেখানে ৬০১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল সেখানে এবার অংশ নিচ্ছে ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৩৭টি প্যাভিলিয়নের ৩৬টিই থাকবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। অন্যটি থাকবে একাডেমি প্রাঙ্গণে। এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তর হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়।
এবার ১ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ ঢুকতে পারবে না। ছুটির দিন চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকাল ৮টায় শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলেন যারা: বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এ বছর ১১টি বিভাগে ১৬ জন পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন—কবিতায় শামীম আজাদ, কথাসাহিত্যে যৌথভাবে নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী, প্রবন্ধ ও গবেষণায় জুলফিকার মতিন, অনুবাদে সালেহা চৌধুরী, নাটকে যৌথভাবে মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক, শিশুসাহিত্যে তপঙ্কর চক্রবর্তী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণায় যৌথভাবে আফরোজা পারভিন এবং আসাদুজ্জামান আসাদ, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় যৌথভাবে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং মো. মজিবুর রহমান, পরিবেশ/বিজ্ঞান ক্ষেত্রে ইনাম আল হক, জীবনীতে ইসহাক খান এবং লোককাহিনিতে যৌথভাবে তপন বাগচী ও সুমন কুমার দাশ।