চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলেছি ভারত সীমান্তবর্তী চরইল বিলের দিকে। পথের দুই পাশে আম বাগান। বেশিরভাগ বাগানেই ঝুলছে আশ্বিনা জাতের আম। অবশ্য এর মাঝে কিছু আম্রপালির বাগানও রয়েছে। মেঠোপথে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটার পর বিলের পাড়ে অরুণ মাঝির দেখা পেলাম। তার নৌকা ঘাটেই বাঁধা ছিল। আমাদের নিয়ে সে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দু-তিনটি বিরল পাখির সন্ধানে এখানে এসেছি। নৌকা ছাড়তেই দেখা হয়ে গেল সেগুলোর মধ্যে একটি অর্থাৎ মাঝারি পানকৌড়ির (Indian Cormorant) সঙ্গে। সেটিকে দিয়েই ক্যামেরার ক্লিক শুরু হলো। মাঝারি পানকৌড়ির ছবি তুলে দ্রুত ভারতীয় সীমান্তের কাছে ধানক্ষেতের দিকে ধাবিত হলাম। পথিমধ্যে বাবুই (Baya Weaver), ধানটুনি (Zitting Cisticola), বিভিন্ন প্রজাতির বক (Egrets) ও সাপগলা পাখির (Snakebird) সঙ্গে দেখা হলো। কিছুটা অনাগ্রহের সঙ্গে সেগুলোর ছবি তুললাম। আরেকটু গেলেই হয়তো আরও দুটি বিরল পাখির দেখা পাব। তাই অরুণ মাঝিকে দ্রুত স্পটে নিতে বললাম। স্পটে এসেই দেখা হয়ে গেল দ্বিতীয় পাখিটির সঙ্গে, যাকে নিয়ে আজকের গল্প। তবে একটি বা দুটি নয়, চার-চারটি পাখি দেখলাম একসঙ্গে; তিনটি প্রাপ্তবয়স্ক ও একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি। ২৯ জুন ২০১৮-এর ঘটনা এটি।
বিদেশের মাটিতে এ প্রজাতির পাখি বহুবার দেখলেও, বহুবার সুন্দর সুন্দর ছবি তুললেও নিজ দেশের মাটিতে প্রথম দেখলাম ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের জুড়িতে, হাকালুকি হওরে। তবে বেশ দূর দিয়ে উড়ে যাওয়া একজোড়া পাখির ছবি তুলে মন ভরল না। এরপর ২০১৭ সালে রাজশাহীর পদ্মার চরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একঝাঁক একই প্রজাতির পাখিতেও মন ভরল না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা চরইল বিলে এসে সে সাধ পূর্ণ হলো। সর্বশেষ সেগুলোদের ৩২টিকে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম ১১ নভেম্বর ২০২৩-এ মুন্সীগঞ্জের পদ্মার নদীতে, পদ্মা সেতুর কাছে।
এতক্ষণ যে পাখিগুলোর গল্প করালাম, সেগুলো এ দেশের এক বিরল ও মহাবিপন্ন সাবেক আবাসিক এবং বর্তমানে পরিযায়ী পাখি সোনাজঙ্ঘা। রঙিলা বক, চিত্রা বক বা রঙিলা সারস নামেও পরিচিত। সাঁওতালরা বলে জাংগিল। ইংরেজি নাম Painted Stork। বৈজ্ঞানিক নাম cteria leucocephala (মিকটেরিয়া লিউকোসেফালা)। সেগুলো মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবাসিক পাখি। বর্তমানে বিশ্বে এগুলো প্রায় শঙ্কাগ্রস্ত।
প্রাপ্তবয়স্ক সোনাজঙ্ঘার দৈর্ঘ্য ৯৩ থেকে ১০২ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ১৫০ থেকে ১৬০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ২.০ থেকে ৩.৫ কেজি। মাথার পালকবিহীন অংশ কমলা-হলুদ। প্রজননকালে পুরুষের মাথা আলতা-লাল হয়ে যায়। চোখের রং খড়ের মতো হলদে। লম্বা চঞ্চুর রং হলুদ। ধূসর-বাদামি পায়ে যেন আলতা মাখা। ঘাড় ও পিঠ সাদা। দেহের নিচটা সাদা ও বুকে কালো ছোপ। ডানার ওপরটা কালো ও তাতে সাদা ছোপ। লেজের পালকেও আলতা-লাল রং মাখা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ফ্যাকাশে সাদা। সেগুলোর মাথা-ঘাড়-ডানার পালক-ঢাকনি বাদামি।
সোনাজঙ্ঘা জলমগ্ন মাঠ, নদীর তীর, জোয়ার-ভাটার কাদাচর, হ্রদ ইত্যাদিতে জোড়ায় জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। অনেক সময় বিশাল দলেও দেখা যায়। একবার রাজশাহীর পদ্মার চরে একসঙ্গে একশতটিরও বেশি পাখি দেখা গিয়েছিল। দিবাচর, জলচর ও ভূচারী পাখিগুলো অল্প পানিতে হেঁটে ও কাদায় চঞ্চু ঢুকিয়ে মাছ, ব্যাঙ, চিংড়ি, বড় কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়। সচরাচর নীরব থাকে; তবে প্রজনন মৌসুমে গোঙানোর মতো শব্দ করে।
জুলাই থেকে অক্টোবর প্রজননকালে সোনাজঙ্ঘা পানিতে দাঁড়ানো উঁচু গাছের মগডালে ডালপালা দিয়ে মাচানের মতো বড়সড় বাসা গড়ে। একই গাছে দলবদ্ধভাবে বাস করে; এমনকি অন্যান্য জলচর পাখি, যেমন বক, পানকৌড়ি, কাস্তেচরা প্রভৃতির সঙ্গেও বাসা করতে পারে। ডিম পাড়ে তিন থেকে চারটি। ডিমের রং সাদা, তাতে লম্বা বাদামি দাগ থাকে। ডিম ফোটে ২৮ থেকে ৩৫ দিনে। বাসা তৈরি, ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালনপালন স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ছানারা প্রায় ২৮ দিনে উড়তে শিখে ও নীল আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে। আয়ুষ্কাল প্রায় আট বছর।
লেখক: পাখি, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর