নিঝুমদ্বীপের নাম শুনলেই চোখে ভাসে মায়াবী হরিণ, সুদীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, দিগন্তবিস্তৃত বিশাল কেওড়া বন। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা এ দ্বীপটিতে কোনো উন্নয়ন না হওয়ায় আজও মলিন। মুজিববর্ষে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেলেও অনুন্নত রাস্তাঘাটের কারণে দ্বীপের আঁধার এখনো কাটেনি। সাগরের জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে পর্যটকরা ছুটে এলেও তারা হতাশা নিয়েই ফিরে যান। এ কারণে সম্ভাবনাময় দ্বীপটিতে দিন দিন কমছে পর্যটক সমাগম।
২০০১ সালে সরকার নিঝুমদ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করলেও এর উন্নয়নে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। দ্বীপে হাতেগোনা কয়েকটি থাকার হোটেল ও রেস্তোরাঁ থাকলেও তা খুবই নিম্নমানের। ১৩ বছর আগে আইলা প্রকল্পের আওতায় আরসিসি ঢালাইয়ের মাধ্যমে বন্দরটিলা ঘাট থেকে নামারবাজার বিচ পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণ করা হয়। এই ১৩ বছরে একবারও তা মেরামত করা হয়নি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে একাধিকবার চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে সড়কটি। প্রতিটি জলোচ্ছ্বাসের পর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সামান্য মাটি দিয়ে খানাখন্দ ভরাট করা হলেও কিছুদিন চলার পর তা আবারও গর্তে পরিণত হয়। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় এই সড়কের ওপর দিয়ে ৬ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়। এতে অনেক জায়গা ভেঙে খালে পরিণত হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, রাস্তার মাঝখানে বিশাল বিশাল গর্ত। জোয়ারের স্রোতে সড়কের নিচের মাটি সরে গিয়ে ভেঙে পড়েছে ওপরের আরসিসি ঢালাইয়ের বিভিন্ন অংশ। মোটরসাইকেলে চলা গেলেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টমটম পার করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। যাত্রীসহ তিন-চারজনকে একসঙ্গে হয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়িগুলো পার করতে দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি জায়গায় যাত্রী নামিয়ে খালি গাড়ি পার করছেন অনেকে।
স্থানীয়রা জানান, এই ভাঙা রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন অনেকে। কয়েক দিন আগেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান নিঝুমদ্বীপ ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আলাউদ্দিনের ছেলে সম্পদ। কয়েক মাস আগে ধানবোঝাই একটি টমটম উল্টে আহত হন এক কৃষক। একইভাবে পা ভেঙে যায় ৩নং ওয়ার্ডের আবুল কালাম নামের আরও এক কৃষকের।
অটোরিকশাচালক জসিম মিয়া বলেন, রাস্তার ঢালাই ভেঙে যাওয়ায় সরু পথ দিয়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। বন্দরটিলা বাজার থেকে যাত্রী এবং মালামাল বোঝাই করে নামার বাজার যাওয়ার সময় আটকা পড়েছি। এখন গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে মাথায় বহন করে ভাঙা অংশটুকু পার করতে হবে। প্রতিদিনই আমাদের এই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
আরেক অটোরিকশাচালক আবুল কালাম বলেন, দিনের বেশিরভাগ সময় স্থানীয় মানুষের চেয়ে পর্যটকদের আনা-নেওয়া করা হয়; কিন্তু রাস্তার এই খারাপ অবস্থা দেখে পর্যটকরা অনেক বিরক্ত হন। অনেকে মোবাইলে অন্যদের না আসার পরামর্শ দেন।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা শিহাব উদ্দিন বলেন, লোকমুখে শুনে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে এসেছি। যে কষ্ট পেয়েছি তাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সব ইচ্ছা মাটি হয়ে গেছে। নৈসর্গিক এ সৌন্দর্যের মায়ায় পরবর্তী সময়ে আবার আসার ইচ্ছা থাকলেও কষ্টের জন্য আসা হবে না।
নিঝুমদ্বীপের বাসিন্দা নান্টু মাঝি বলেন, আশ্বাসে আশ্বাসে দিন যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমরা শুনেছি এই ব্রিজটা হবে, তবে কবে হবে জানি না। এই ব্রিজ ও সংযোগ সড়কটা দ্রুত হলে পর্যটকদের জন্য যেমন ভালো হতো, আমাদের জন্যও ভালো হতো।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. কেফায়েত হোসেন বলেন, পর্যটক একটু কম। রাস্তাঘাট ভালো নয়, তাই পর্যটক এসে কষ্ট পান। নিঝুমদ্বীপে দেখার অনেক কিছু রয়েছে। যেমন চৌধুরী খাল, চর কবিরা, দমার চর, পালকির চর। এ ছাড়া সমুদ্রসৈকত, মায়াবী হরিণ ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল তো আছেই। রাস্তাঘাট ভালো হলে পর্যটকরা এসব দেখতে আসবেন।
দ্বীপটিতে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য সরকারিভাবে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, বর্তমানে পর্যটকদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত আবাসন নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থাও খারাপ। তবে বর্তমানে এর উন্নয়নে কাজ চলছে। এ ছাড়া নিঝুমদ্বীপের প্রধান যে সড়কটি তা প্রতি বছর পরিবেশগত কারণেই বিপর্যস্ত হয়ে যায়। আমরা যদি বরাদ্দ পাই তাহলে সড়কটি সুন্দর করতে পারব। আমাদের ডাকবাংলো আছে, কিছু রিসোর্ট আছে। যদি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেন, তাহলে আবাসন ব্যবস্থার আরও উন্নতি হবে। পর্যটন করপোরেশন একটি আবাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেটি চলমান রয়েছে।