আমজাদ হোসেন শিমুল, রাজশাহী
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪, ০৩:২৩ এএম
আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৪, ১০:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতারণা করে ফুটপাত থেকে ‘রাজপ্রাসাদে’

অর্থ আত্মসাৎ
প্রতারণা করে ফুটপাত থেকে ‘রাজপ্রাসাদে’

মোস্তাফিজুর রহমান। ‘গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি লিমিটেডের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। বছরচারেক আগে পালিত বাবার পেনশনের জমানো ৯০ লাখ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে শুরু করেন এই আবাসন ব্যবসা। তবে এই আবাসন ব্যবসায় নেই রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অনুমোদন। অনুমোদনহীন এই অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে প্রতারণা করে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এভাবে প্রতারণা করে তিনি অল্প সময়েই ফুটপাত থেকে পৌঁছে গেছেন ‘রাজপ্রাসাদে’। চড়েন বিলাসবহুল হ্যারিয়ার গাড়িতে। তার জীবনযাপন দেখলে মনে হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের রাজপুত্র। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের মতো প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদও বাগিয়ে নিয়েছিলেন একবার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার আব্দুর রাকিবের ছেলে মোস্তাফিজ (৩০)। পড়াশোনার সুবাদে বেশ কয়েক বছর আগে চলে আসেন রাজশাহী শহরে। দরিদ্র পরিবারের মোস্তাফিজ আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আশ্রয় নেন রাজশাহী নগরীর রাজারহাতা এলাকার প্রয়াত ব্যাংক কর্মকর্তা মাইনুল হাসানের বাড়িতে। নিঃসন্তান মাইনুল দম্পতির দত্তক ছেলে হয়ে যান তিনি। পালিত বাবা মাইনুল পেনশনের ৯০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন। মাইনুলের মৃত্যুর পরে পালিত মা নাসরিন সুলতানার কাছ থেকে কৌশলে সেই টাকা হাতিয়ে নেন। সেই টাকা দিয়ে বছর চারেক আগে ‘গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে আবাসন ব্যবসার নামে খুলে বসেন প্রতারণার ফাঁদ। শুরুতে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানা মোড়ের একটি জায়গায় সাত তলা ভবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে তার প্রতারণা-ব্যবসার যাত্রা। এরপর একই ফ্ল্যাট দুই-তিন জায়গায় বিক্রির মাধ্যমে ধীরে ধীরে চাঙ্গা হতে থাকে তার আবাসন ব্যবসা।

কিছুদিন আগে মোস্তাফিজ ৫টি জায়গা নিয়ে দুটিতে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেন। একেকটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেন একাধিক ব্যক্তির কাছে। বাকিগুলোতে কাজ শুরু করতে না পারলেও ফ্ল্যাট বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। জমির মালিকদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি কাউকেই ঠিকমতো দেননি ভাড়া। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে ক্ষমতার প্রভাবে কাউকে উল্টো মামলা দিয়ে জেলও খাটিয়েছেন তিনি।

এমন একজন ভুক্তভোগী নগরীর দরিখরবোনা এলাকার আবু হানিফ। বছরখানেক আগে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে তার কাছ থেকে জমির বন্দোবস্ত নেন মোস্তাফিজ। কিন্তু বাড়ির কাজ শুরু করতে পারেননি। এমনকি হানিফকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও সেটিও দেননি মোস্তাফিজ। বাধ্য হয়ে হানিফ জমিটি অপর এক ডেভেলপারকে রেজিস্ট্রি করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোস্তাফিজ হানিফের নামে উল্টো মামলা দিয়ে আড়াই মাস জেল খাটান। পরে জামিনে মুক্তি পান হানিফ। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে মোস্তাফিজ। আমি এর বিচার চাই। আমি জমি মালিক। অথচ আমাকেই জেল খাটতে হলো।’

আরেক ভুক্তভোগী রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক মহিবুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমার একটি জমিতে ভবন নির্মাণ করার জন্য মোস্তাফিজকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে কোনো শর্তই মানেনি। এরপর আমি চুক্তি বাতিল করেছি। কিন্তু মোস্তাফিজকে ১০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। সে একজন প্রতারক। প্রতারণাই তার কাজ।’

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলে ২৫ লাখ টাকা নিয়েছিল মোস্তাফিজ। কিন্তু পরে জানতে পারি, ওই ফ্ল্যাটটি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। শেষে আমি মেয়র সাহেব ও নগর পুলিশের কাছে অভিযোগ করে কয়েক মাস ঘুরে সেই টাকা উদ্ধার করেছি।’

রাজশাহী নগরীর বালিয়া পুকুর এলাকার ওমর ফারুক নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাকেও ফ্ল্যাট দেবে বলে ৩৫ লাখ টাকা নিয়েছিল। শেষে একাধিকবার সালিশ করে কয়েক দফায় সেই টাকা আমি নিয়েছি। এখনো লাখ তিনেক টাকা পাই।’

অভিযুক্ত মোস্তাফিজের পালিত মামা ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, ‘মোস্তাফিজকে আমার ভগ্নিপতি পালিত ছেলে বানিয়েছিল। আমার ভগ্নিপতি মারা যাওয়ার পর তার পেনশনের ৯০ লাখ টাকা মোস্তাফিজ আমার বোনের কাছ থেকে চিট করে নিয়েছে। তিন বছর আগে আমাদের একটা জমিও ডেভলপার হিসেবে নিয়েছে। ওই জমিতে থাকা বাড়িটি ভেঙে ফেললেও এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি। আমরা এখন ভাড়া বাড়িতে থাকি। এই ছেলেটির কারণে আমার বোন এখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যেই কান্নাকাটি করে।’

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মোস্তাফিজ এভাবে রাজশাহী নগরী ও আশপাশের জেলার অন্তত অর্ধশত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টাকা ফেরত দেওয়ার ভয়ে তিনি অনেকটা সময় পলাতক থাকছেন। ঠিকমতো অফিসেও বসছেন না।

রাজশাহী নগরীতে আবাসন ব্যবসা করতে হলে আরডিএর অনুমোদিত ব্যবসায়ী হতে হয়। কিন্তু গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেটের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই আরডিএতে। অথচ গত প্রায় ৪ বছর বছর ধরে নগরীতে আবাসন ব্যবসার নামে মোস্তাফিজ প্রতারণা করে যাচ্ছে। আরডিএর দেওয়া তথ্য মতে, তাদের তালিকাভুক্ত বৈধ ব্যবসায়ী আছেন ২৬ জন। এ তালিকায় গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেট নেই।

এ বিষয়ে আরডিএর অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘এই নামে (গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেট) আরডিএর কোনো নিবন্ধিত আবাসন প্রতিষ্ঠান নেই। আরডিএর নিবন্ধিত আবাসন প্রতিষ্ঠান ছাড়া আবাসন ব্যবসা করারও কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এসব অবিনন্ধিত প্রতিষ্ঠান কোনো নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগসাজশ করে অথবা জমির মালিকের নামে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন নেয়। এরপর তারা ব্যবসা করে।’ তবে আরডিএ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

মোস্তাফিজের প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকুও। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘এই মোস্তাফিজ এর আগের টার্মে চেম্বারের পরিচালক ছিলেন। সেই সুবাদে আমার কাছেও চারটি অভিযোগ এসেছিল। এর মধ্যে ৪০ লাখ টাকার একটি অভিযোগ মীমাংসা করতে পেরেছিলাম। বাকি ৪৯ লাখ, ১২ লাখ ৮০ হাজার এবং ১০ লাখ টাকার তিনটি অভিযোগ আমি মীমাংসা করতে পারিনি। কেননা, চেম্বারের পরিচালক হওয়ায় তিনি এই পদটাকে প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতেন। এটি জানাজানি হওয়ায় দ্বিতীয়বার আর চেম্বারের কোনো দায়িত্বে তিনি নেই। যেহেতু তিনি এখন চেম্বারের কেউ না। তাই পরের অভিযোগগুলো আমি মীমাংসা করতে পারিনি। বিভিন্ন কারণে স্লিপ কেটে গেছে।’

অভিযোগের বিষয়ে গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি লিমিটেডের এমডি মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে প্রতারণা করিনি। অনেক সময় নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে ভবন মালিকদের সঙ্গে বসতে হয়েছে। আবার কেউ ফ্ল্যাট না নিলে তাকে টাকা ফেরত দিতেই হবে। অনেকেই টাকা পেতেন। তবে সেই টাকা ১৪ মাস আগে ফেরত দেওয়া হয়ে গেছে। এখন কেউ কোনো টাকা পাবেন না।’ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের না থাকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আরডিএর প্ল্যান ছাড়া কোনো বিল্ডিংয়ের কাজ করা সম্ভব নয়।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘রাইসির ঘটনায়’ উচ্ছ্বসিত মার্কিন সিনেটর

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনিয়ে পালাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্য

রাইসিকে উদ্ধারকাজে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে রাশিয়া

রাইসিকে উদ্ধারের সর্বশেষ অবস্থা জানাল ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

সংস্কারের দুদিন পরই উঠে যাচ্ছে কোটি টাকার কার্পেটিং!

বজ্রপাতে কলেজছাত্রের মৃত্যু

ঘুষ নিয়ে এএসআইয়ের দর-কষাকষির অডিও ভাইরাল

রাইসির খোঁজে যে ঘোষণা দিল এরদোয়ান

গণপিটুনির শিকার আ.লীগ নেতা

১০

রাইসির খোঁজে এগিয়ে এসেছে যেসব দেশ

১১

রাইসির খোঁজে ৩২ সদস্যের দল পাঠাচ্ছে তুরস্ক

১২

ইরানের প্রেসিডেন্টের দুর্ঘটনাস্থল থেকে মিলল সংকেত

১৩

কেন এত সময় লাগছে অনুসন্ধানে

১৪

টানা চারটি লিগ জয়ীদের এলিট ক্লাবে ম্যানসিটি

১৫

হেলিকপ্টার পাওয়ার বিষয়ে যা জানাল রেড ক্রিসেন্ট

১৬

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

১৭

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

১৮

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

১৯

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

২০
X