শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৬ এএম
আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পলিথিন-প্লাস্টিকের বর্জ্যে বিপন্ন দেশ

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস আজ
পলিথিন-প্লাস্টিকের বর্জ্যে বিপন্ন দেশ

বাংলাদেশ ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। এর দুই বছর পর দেশের বাজারগুলো পলিথিনমুক্ত হয়। মানুষ তখন ভেবেছিল দেশ এবার পলিথিনমুক্ত হয়েছে। কিন্তু সে ভাবনার আশায় গুড়ে বালি। কয়েক বছরের মধ্যে দেশ আবার ছেয়ে গেছে পলিথিনে। বর্তমানে বৈধ পণ্যের মতোই ব্যাগটি ব্যবহার হচ্ছে। দেশে প্রতিদিন ৩ হাজার কারখানায় ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও নেই কোনো বাস্তবায়ন। পলিথিনের মতো প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার অব্যাহতভাবে বাড়লেও লাগাম টানতে নেই কোনো উদ্যোগ। প্লাস্টিকের নীল বিষে মাটি, পানি, বায়ুসহ প্রকৃতি ধুঁকছে। মাছের পেট থেকে মানুষের পেটে যাচ্ছে প্লাস্টিক। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছে। দূষণে মাটি হারিয়ে ফেলছে উৎপাদন ক্ষমতা। হুমকিতে জীববৈচিত্র্য। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

এমন প্রেক্ষাপটে ‘প্ল্যানেট বনাম প্লাস্টিক’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ সোমবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোতে রাস্তায় নেমে এসেছিল প্রায় দুই কোটি মানুষ। মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তারা তার প্রতিবাদ করেছিল। পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় ওই বছর থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগের চান্দিরঘাট এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় অননুমোদিত প্লাস্টিক উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে ৯শরও বেশি অবৈধ পলিথিনের কারখানা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদী, বরিশালের কীর্তনখোলা নদী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এ কারণে নদী দূষণের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিনের প্রভাবে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নদীতে কমছে মাছের সংখ্যাও।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়। সারা দেশের যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার ৩০ শতাংশের বেশি হয় রাজধানী ঢাকায়। দেশের প্রধান শহরটিতে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন, অর্থাৎ দিনে ৬৮১ টনের মতো বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সারা দেশে দিনে এর পরিমাণ ২ হাজার ২৫০ টন। দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করলেও রাজধানীতে এটি দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৮ কেজি। যদিও ২০০৫ সালে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ৩ কেজি ছিল। দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ রাস্তাঘাট ও নদীতে যাচ্ছে। মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে ঢুকে সেগুলো মানুষের জীবনচক্র ও শরীরে প্রবেশ করছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশে রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হয়। সেখান থেকে নালা ও খাল হয়ে নদীতে যায়। সর্বশেষ এগুলোর ঠাঁই হয় বঙ্গোপসাগরে। দেশের তিন প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় দিনে ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক ও পলিথিন পড়ে।

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, প্লাস্টিক মাটি ও পানির ক্ষতি করে মানুষের বিপদ ডেকে আনছে। এসব প্লাস্টিকের সঙ্গে নানা বিষাক্ত রাসায়নিক রয়েছে। এসব রাসায়নিক মাটির সঙ্গে, পোড়ানোর পর বাতাসের সঙ্গে এবং খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মানুষের শরীরে ঢুকছে। ফলে উচ্চরক্তচাপ থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো রোগ ছড়াচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, আমরা ১৮ প্রজাতির ৪৮টি মাছের ওপর পরীক্ষা চালায়। এর মধ্যে ১৫ প্রজাতির মাছের পরিপাকতন্ত্রে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ঢাকার কাছে সাভার ও আশুলিয়ার দুটি বাজার থেকে এসব মাছ কেনা হয়। এসব মাছ দেশের নদীনালা, খালবিল, পুকুর ও জলাশয়ের স্বাদু পানিতে পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য পানিতে ফেললে ফটোকেমিক্যালি ও বায়োলজিক্যালি ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এগুলো পানিতে ফেললে মাছ খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলে। এভাবে মাছের শরীরে প্লাস্টিক চলে যায় মানুষের দেহে। এতে ক্যান্সারসহ নানা রোগ হতে পারে।

বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। যদিও আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২১ সালের মধ্যে এ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার আদেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর তিন বছর কেটে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা মনে করছি প্লাস্টিক সস্তা। কিন্তু লবণ, চিনি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আমার-আপনার পেটের ভেতরেও প্লাস্টিক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মায়ের দুধেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কম দামের প্লাস্টিকে সাময়িক লাভ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। একটা প্লাস্টিক বোতল ১ হাজার বছর, পলিব্যাগ ৪৫০ বছর ও প্লাস্টিকের স্ট্র ৭০০ বছর টিকে থাকতে পারে। বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ টন প্লাস্টিক বিভিন্ন সমুদ্রে যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে বছরে এক লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেশিরভাগ দায়িত্ব উৎপাদকদেরই নিতে হবে। ভোক্তাদের আচরণে বদল আনাও তাদের দায়িত্ব। তাদের প্লাস্টিকের বিকল্প দিতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাদা আইন প্রয়োজন। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আইনে আছে, ১৪টি পণ্যে পলিথিন প্যাকেট দেওয়া যাবে না। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের মোট বর্জ্যের ২০ থেকে ৩০ শতাংশই প্লাস্টিক। ফলে যেখানেই বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে, সেখানে প্লাস্টিকও পুড়ছে। এতে বাড়ছে বায়ুদূষণ। প্লাস্টিকের পুড়ে যাওয়া অংশ মাটি ও পানিতে মিশছে।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। সমুদ্রের তলদেশ পলিথিন ও প্লাস্টিকে ভরে গেছে। একটি পলিথিন মাটিতে পুঁতে রাখলে তা নষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় চারশ বছর। এক কথায় পলিথিন ও প্লাস্টিক আমাদের সামগ্রিক জীবন খেয়ে ফেলছে। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন শুধু কাগজে-কলমে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে প্লাস্টিক নিয়ে কোনো সচেতনতা নেই, কর্মসূচিও নেই। কখনো কখনো দু-এক দিনের কর্মসূচি বা অভিযান হয়। কিন্তু তারপর আবার যেমন আছে তেমনই চলতে থাকে।

বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, নিঃসন্দেহে পলিথিন ও প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সমস্যা হচ্ছে, যে কাঁচামাল দিয়ে পলিথিন তৈরি হয়, তা অন্য শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। ফলে চাইলেই আমরা পলিথিনের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ করতে পারি না। শিগগির ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব দ্রুত পচনশীল প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে ক্ষতিকর প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করা হবে।

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইন ও বিধিগত কিছু সমস্যা আছে। রয়েছে জনবল সংকটও। অভিযান পরিচালনা করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা পলিথিন ও ক্ষতিকর প্লাস্টিক উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে শিগগির অভিযান পরিচালনা করব। তবে এটা সত্যি যে, আমরা পরিবেশ রক্ষা বা সংরক্ষণে সফল হতে পারিনি। না পারার দায় স্বীকার করা একটি বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্রিটিশ অস্ত্রে সরাসরি রাশিয়ায় হামলার অনুমতি দিল যুক্তরাজ্য

ধর্ষণ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

জবি হলে আগুন, আতঙ্কে জ্ঞান হারালেন ছাত্রী

রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে আশাবাদী বাংলাদেশ-গাম্বিয়া

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

সকালের মধ্যে তীব্র ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

আজ বন্ধ থাকবে যেসব জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

৪ মে : নামাজের সময়সূচি

বিরল প্রজাতির আশ্চর্যজনক ছাগল

১০

২০ বছর পর ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সুজন

১১

আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ

১২

২ টাকার বেগুন এখন ৬০ টাকা

১৩

বাকৃবিতে বৃক্ষনিধনের প্রতিবাদ

১৪

জ্যামিতির কম্পাস দিয়ে শিক্ষক বাবাকে মেরেই ফেলল ছেলে

১৫

বিএনপির দুই নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

১৬

কুমিল্লায় ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ ও বঙ্গবন্ধু ধান ১০০ নিয়ে মাঠ দিবস

১৭

ওয়েস্ট টু হোপের বার্ষিক মিট আপ অনুষ্ঠিত

১৮

তীব্র তাপদাহের পর ভোলায় স্বস্তির বৃষ্টি

১৯

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান হলেন ওহিদুজ্জামান

২০
*/ ?>
X