বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ কেনার টাকা পরিশোধের সময় পরিশোধিত মোট টাকার ওপর ৬ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি এ উৎসে কর প্রত্যাহার চেয়ে এনবিআরে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমে আসবে এবং ঋণ ও বিল পরিশোধের বিপরীতে ছাড়া বন্ডের ওপর নির্ভরশীলতাও কমবে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে ভর্তুকি না পেয়ে নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। এ অবস্থায় ভর্তুকির দায় পরিশোধের জন্য বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু শুরু করেছে সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে ২৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১০ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। নতুন করে এখন আবার ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি, আদানিসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট ভর্তুকির প্রায় ১৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা গত মার্চ থেকে পরবর্তী চার মাসে পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। মার্চের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে ভর্তুকির অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড় করার অনুরোধ ছিল। তবে সরকারের কোষাগারে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় গত ২৮ মার্চ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর এ খাতে আর কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা এনবিআরকে বলেছি উৎসে কর প্রত্যাহার করতে। এটা প্রত্যাহার করলে ভর্তুকি কমবে। পাশাপাশি ঋণ ও বন্ডের ওপর নির্ভরতা কমবে। তিনি আরও জানান, এটি প্রত্যাহার করলে ভর্তুকির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
গত সপ্তাহে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হাবিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইন অনুযায়ী পিডিবি বা বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত কোনো কোম্পানিকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের অর্থ পরিশোধকালে প্রদেয় অর্থের ওপর ৬ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা (বিইআরসি) সরকারের বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বাল্ক বিদ্যুৎ বিক্রয় মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের কল্যাণ বিবেচনায় কোনো প্রকার কর ও মুনাফা বিবেচনা করা হয়নি। এ ছাড়া পিডিবির ব্যয় বিক্রয় মূল্য দ্বারা নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় প্রতি বছর পিডিবির বিপুল পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। ৬ শতাংশ উৎসে করের জন্য প্রতি বছর লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এতে বলা হয়, পিডিবি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও অপরিচালনা আয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ না থাকায় বিপুল পরিমাণ ৬ শতাংশ উৎসে কর প্রদানের পরও অপরিচালনা খাতের আয়ের জন্য আলাদা কর দাবি করা হচ্ছে। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ ট্যারিফের খরচ নির্ধারিত। যার মধ্যে জ্বালানি বিলের পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ। অবশিষ্ট ফিক্সড কস্ট, ঋণের কিস্তি এবং পরিচালনায় ব্যয় হচ্ছে। ফলে মোট বিলের ওপর ৬ শতাংশ হিসেবে বিপুল পরিমাণ উৎসে কর কর্তন করায় কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য আর্থিক সংকটে ভুগছে।
ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রেখেছে, সেইসঙ্গে বাড়িয়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট, এ চাহিদা বৃদ্ধির হার বছরে ১১ শতাংশ। এ পরিমাণ বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে সচল রাখতে একদিকে যেমন বিপুল অর্থের প্রয়োজন, অন্যদিকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, পিডিবির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর মাসিক বিদ্যুৎ বিল থেকে ৬ শতাংশ আয়কর কর্তনের ফলে বার্ষিক করপোরেট কর উৎসে কর আদায়ের চেয়ে অনেক কম হয়। কোম্পানিগুলোর বিল থেকে উৎসে কর কর্তনের ফলে কোম্পানিগুলো আর্থিকভাবে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ৬ শতাংশ উৎসে কর বহাল রাখলে পিডিবির সঙ্গে কোম্পানির স্বাক্ষরিত চুক্তি সংশোধন করার প্রয়োজন হবে। চুক্তি সংশোধন করলে ৬ শতাংশ কর পিডিবির ওপর বর্তাবে। এর ফলে পিডিবি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা ভর্তুকির মাধ্যমে পুনর্ভরণ করা প্রয়োজন হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, পিডিবি এবং সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে নির্ধারিত ট্যারিফের ওপর ৬ শতাংশ এবং বিতরণকারী সংস্থা বা কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত বাল্ক ট্যারিফের ওপর অতিরিক্ত ৬ শতাংশ আয়কর ধার্য করা হচ্ছে, যা দ্বৈত কর আরোপ। বিদ্যুৎ বিল থেকে ৬ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করা হলে কর-পরবর্তী বছরে প্রদেয় করপোরেট করের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। তবে বিদ্যুৎ বিলের মধ্যে ফুয়েল (এইচএফও, ডিজেল ও গ্যাস) অংশ পিপিএ (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) পাস থ্রু আইটেম হওয়ায় এর বিপরীতে কর্তনকৃত উৎসে কর পুরোপুরি সমন্বয়ের সুযোগ হচ্ছে না। জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর কর্তন করে বিধায় ওই কর উৎসে দুবার কর্তন হচ্ছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য এ ৬ শতাংশ কর সংস্থান না থাকায় কোম্পানিগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি, আদানিসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ মোট অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া একই সময়ে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ও দেশীয় আমদানিনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে গত জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত বিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। নগদ অর্থে পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ায় বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে দায় পরিশোধ করা হচ্ছে।