দিনাজপুরে খানসামা উপজেলার প্রায় ২৫৮ বছরের পুরোনো ‘আওকরা মসজিদ’। আঙ্গারপাড়া ইউনিয়নের পাকেরহাট গ্রামের সীমান্তে হাসিমপুর এলাকা। সে এলাকার বুক চিরে বয়ে চলা বেলান নদীতীরে মির্জার মাঠ। আর সেখানেই অবস্থান এ মসজিদের।
প্রাচীন মসজিদটিকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে নানা অলৌকিক কেচ্ছা-কাহিনি। নামকরণের পেছনেও আছে ইতিহাস। স্থানীয় শব্দ ‘আওকরা’। যার অর্থ কথা বলা। জনশ্রুত আছে, এ মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কথা বললে প্রতিধ্বনি হয়ে সে শব্দ ফিরে আসত। তাই স্থানীয়রা মসজিদের নাম রাখেন আওকরা বা কথা বলা মসজিদ। নির্মাণের সময় মসজিদটি ঠিক কী নামে পরিচিত ছিল, তা কেউই বলতে পারেননি। জানা যায়, একসময় আশপাশজুড়ে ছিল মুসলিম জনবসতি। মির্জা লাল বেগ নামে এক ব্যক্তি তাদের জন্য ১৭৬৬ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। সে সময় নামাজ আদায়ের পাশাপাশি সেখানে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও পালন করা হতো। মসজিদ কেন্দ্র করে মির্জার মাঠেই আওকরা নামে পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
সরেজমিন দেখা যায়, সরু আর ছোট ছোট ইটে নির্মিত মসজিদটি। সবার নজর কেড়েছে দেয়ালের মনোমুগ্ধকর নকশা আর সুন্দর রঙে। ভেতরেও হালকা কারুকার্য। তবে সংস্কারের অভাবে প্রাচীরগুলোতে ফাটল ধরেছে। পরিস্থিতি এমন, যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে মসজিদটি।
এলাকাবাসী জানান, জিন, ভূত এবং সাপ ও ক্ষতিকর পোকামাকড়ের ভয়ে কেউ সেখানে যেতে চায় না, সেজন্যই মূলত বেহাল দশা। বেশ কয়বছর আগে স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী মিলে মসজিদের চারপাশের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে নামাজ আদায়ের পরিবেশ তৈরি করে। পরে ফাটল দেখা দিলে প্রাচীরের পাশে টিনশেড বেড়া নির্মাণ করে নামাজ পড়েছেন মুসল্লিরা।
এদিকে জরাজীর্ণ দশা হলেও ঐতিহ্য, নন্দনশৈলী আর বয়স বিবেচনায় মসজিদটিকে ঘিরে আশপাশের মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বয়সী দর্শনার্থীর আনাগোনা লেগে থাকে বছরজুড়েই। কিন্তু অযত্ন-অবহেলা আর দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে ধীরে ধীরে বিলীনের পথে শতবছরের পুরোনো নিদর্শনটি। যদিও বেশ কয়বছর আগে এটিকে ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা কাগজে-কলমে আর সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ। কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়নি। এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত মসজিদটি সংস্কার করার। স্থানীয় মোকছেদুল ইসলাম জানান, ঝোপঝাড় পরিষ্কার করলেও দেয়ালের ফাটলের কারণে আতঙ্কে থাকতে হয়। তাই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিত, তাহলে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতো এ মসজিদ।
মছির উদ্দিন নামে আরেকজন বলেন, এ মসজিদ কবে নির্মাণ করা হয়েছে, তা দাদাও বলতে পারেননি। এটা অনেক আগের। তাই এখনই যদি সংস্কার করা না হয় প্রাচীন এ নিদর্শনটি হারিয়ে যাবে। ঐতিহাসিক স্থাপনার কথা ভুলে যাবে নতুন প্রজন্ম।
মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর, আশা করছি সরকার দ্রুত সংস্কার করে দেবেন। তাহলে সবাই নিরাপদে নামাজ আদায় করতে পারব।’
আওকারা মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. মফিজ উদ্দিন বলেন, গ্রামবাসীর সহযোগিতায় মসজিদে টিনের ছাউনি, মাইক ও নলকূপ স্থাপন করেছি। কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত সংস্কার না করলে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
দিনাজপুর প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর ও কান্তজিউ মন্দিরের সহকারী কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান বলেন, যত দ্রুত সম্ভব ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি পরিদর্শন করে সংস্কার করা হবে।
মসজিদটির সংলগ্ন একটি ভিত্তিপ্রস্তর ছিল। তাতে ছিল মির্জা লাই বেগ। ধারণা করা হচ্ছে, মোগল আমলে নির্মিত হয়েছে মসজিদটি। সম্রাট আকবরের দ্বীন-ই-এলাহী মতবাদের ভিত্তিতে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। একই সঙ্গে ওই এলাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ও আছে। মসজিদটি উপজেলার গোয়ালডিহি ইউনিয়নে অবস্থিত।