ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সব কৌশল ব্যর্থ করে দিচ্ছেন মন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতারা। চেয়ারম্যান পদে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে এই নেতারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রাখছেন। তাদের ভূমিকার কারণে অনেক উপজেলায় নির্বাচন একতরফা হয়ে পড়ছে। এতে ভোটার উপস্থিতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চলমান উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটের হার এক শতাংশ বাড়লেও তা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা প্রচার চালাতে পারেন না, কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজও করতে পারবেন না। কিন্তু তার পরও তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। তারা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে প্রভাব বিস্তার তো করছেনই, কেউ কেউ প্রকাশ্যেও তাদের তৎপর আছেন। এজন্য একজন এমপিকে সতর্কও করেছে নির্বাচন কমিশন। মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব ঠেকাতে স্পিকারের ভূমিকা চেয়ে সংসদ সচিবালয়কে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, বেশ কয়েকটি কারণে নির্বাচনে ভোটের হার কম। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না আসা, প্রার্থীর সংখ্যা কম হওয়ায় ভোটারদের পছন্দের বিকল্প প্রার্থী না থাকায় ভোটের হার কমার অন্যতম কারণ। তা ছাড়া ভোটাররা যাকেই ভোট দিক, আওয়ামী লীগের কেউ না কেউ নির্বাচিত হবে—এমন চিন্তা থেকেও অনেকে ভোটকেন্দ্রে আসেন না। ভোটে প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতারা ও মন্ত্রী-এমপিদের কেউ প্রকাশ্যে ও গোপনে সমর্থন দেওয়ায় ভোটারদের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান কালবেলাকে বলেন, ‘ঠিক কত শতাংশ ভোট না পড়লে নির্বাচন ব্যর্থ হবে—এমন কোনো কিছু সংবিধানে উল্লেখ নেই। একই মানসিকতার কেউ নির্বাচনে জয়ী হলে এমপির জন্য কাজ করতে সুবিধা হয়। সেজন্য কেউ কেউ গোপনে কোনো প্রার্থীর জন্য কাজ করে থাকতে পারেন।’
জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপের ১৫৬টি উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩৭.৫৬ শতাংশ ভোট পড়ে, যা প্রথম ধাপের (৩৬.১) চেয়ে এক শতাংশ বেশি।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘কত শতাংশ ভোট পড়েছে, সেটা বড় বিষয় না, মানুষ নিরাপদে ভোট দিতে পেরেছে—এটা বড় অর্জন। এখন তো বিএনপি আমলের মতো হুন্ডা-গুণ্ডার নির্বাচন হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভোটে মানুষের শঙ্কা কেটে যাচ্ছে, আস্থা বাড়ায় সামনের নির্বাচনগুলোতে ভোটের হার বাড়বে।’
জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ১৭টি উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। তাদের মধ্যে তিনটি বাদে সবগুলোতেই স্বজনরা জয়ী হয়েছেন।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীরা সবাই স্থানীয় এমপিদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। কালিহাতী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই শামীম আল মনসুর সিদ্দিকী ওরফে আজাদ সিদ্দিকী। তাকে সমর্থন দেন দুই ভাই লতিফ সিদ্দিকী এবং আবদুল কাদের সিদ্দিকী। ভূঞাপুর উপজেলায় স্থানীয় এমপি তানভীর হাসান ছোট মনিরের আশীর্বাদপুষ্ট বর্তমান চেয়ারম্যান নার্গিস আক্তার পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন। ঘাটাইল উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আরিফ হোসেনকে সমর্থন দেন স্থানীয় এমপি আমানুর রহমান খান রানা।
এদিকে কিছু কিছু জায়গায় এমপি সমর্থিত হয়েও হেরেছেন কেউ কেউ। কোথাও কোথাও দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেন দুই এমপি। গাইবান্ধা সদর উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহ সারোয়ার কবীর সমর্থন পেয়েও হেরে যান ইস্তিকুর রহমান সরকার। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় গোলাম সারওয়ারের পক্ষে অবস্থান নেন তার ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বর্তমান মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিজয়ী প্রার্থী আবদুল হাইয়ের পক্ষে অবস্থান নেন কুমিল্লা-৬ আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দীন। জয়পুরহাট সদর উপজেলায় হাসানুজ্জামান মিঠু ছিলেন জয়পুরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদুর সমর্থিত প্রার্থী। পরাজিত প্রার্থী এ ই এম মাসুদ রেজা ছিলেন জয়পুরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের আশীর্বাদপুষ্ট। যদিও প্রকাশ্যে দুই এমপি কাউকে সমর্থনের বিষয়ে কিছু বলেননি।