নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় চলছে ইসলামী মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন। যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও নিম্নতম পদের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসহ একাধিক বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন একাধিক উপ-পরিচালক। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ফাউন্ডেশনের গাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চারটি গাড়ি ব্যবহার করছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার। ফাউন্ডেশনের চতুর্থ গ্রেডের একজন কর্মকর্তার প্রাপ্য গাড়ি নিয়ে সচিব তার পিএস-টুকে দিয়েছেন, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো খ-১১৯৩৭৫। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আউটসোর্সিংয়ের গাড়ি (নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩৫২৯২) মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত দেখিয়ে সচিবের স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। ইসলমিক ফাউন্ডেশনের আরও দুটি গাড়ি ধর্ম সচিবের দপ্তরে সংযুক্ত আছে। এর মধ্যে একটি তিনি নিজে ব্যবহার করেন। আরেকটি তার বাসার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই গাড়ি দুটির চালক হিসেবে আছেন মো. মাসুদুর রহমান ও মো. জহিরুল ইসলাম। সরকারের টাকায় জ্বালানি ও চালকদের বেতনসহ সব খরচ দেওয়া হলেও চারটি গাড়ি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন ধর্ম সচিব। অথচ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি।
এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আপন ছোট ভাইকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ। তিনি ওই নিয়োগ পরীক্ষার পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। পরীক্ষা চলাকালে তিনি মৌখিক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভাইকে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক থাকা অবস্থায় ইসলামী প্রকাশনা, অনুবাদ, গবেষণা ও বিশ্বকোষ প্রকল্পের অধীনে ‘বিক্রয় সহকারী’ পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা কমিটির সহযোগী হিসেবে শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক বিদ্যালয় কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন হারুনুর রশিদ; কিন্তু সেখানে দায়িত্ব পালন না করে তিনি ছোট ভাইকে লিখিত পরীক্ষায় মৌখিকভাবে এবং মোবাইলে সহায়তা করেন। এ জন্য হারুনুর রশিদকে কারণ দর্শানো নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। এ অভিযোগে তখন তাকে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় বদলি করা হলেও তিনি সেখানে না গিয়ে ঢাকায় অবস্থান করেন। সেই সময় বদলির আদেশ বাতিলের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির করায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য তাকে শোকজ করা হয়।
হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নেওয়া ও প্রকল্পের টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালে টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ভুয়া স্বাক্ষর ব্যবহার করে দুটি চেকের মাধ্যমে ৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে কৈফিয়তের জন্য তাকে তলব করেছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পরে বিষয়টি তদন্তের জন্য চার সদস্যের কমিটি করা গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটি টাকা জালিয়াতির প্রমাণ পেলেও হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে ড. মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যথাযথ সম্মান না দিয়ে ‘মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৭০-৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কে ‘দুর্যোগপূর্ণ দিন’ অখ্যায়িত করেছেন তিনি। স্বাধীনতাবরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ততা সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি হারুনূর রশিদকে তলব করেছিল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ (সিটিটিসি)। এতকিছুর পরও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে একের পর এক নতুন দায়িত্ব দিয়ে এই কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ হারুনূর রশিদ বর্তমানে যাকাত বিভাগের পরিচালকের চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। তারপরও তাকে প্রেস ব্যবস্থাপকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও গবেষণা, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বও পেয়েছেন হারুন।
যোগাযোগ করা হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যাকাত বিভাগের দায়িত্ব পালন করছি। এ ছাড়া অন্য দায়িত্ব পালন করি না। আমি কোনোদিন অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। এখনো নেই।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিধিতে বলা হয়ছে, সংশ্লিষ্ট পদের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো কর্মচারীকে অতিরিক্ত কিংবা চলতি দায়িত্ব দেওয়া যাবে না; কিন্তু এই বিধির কোনো তোয়াক্কা না করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চাটুকার ও দুর্নীতিবাজ উপ-পরিচালকদের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান এবং প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছেন।
উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আইসিটি বিভাগের পরিচালক হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে পরিকল্পনা বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে উপ-পরিচালক মো.আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে জেলায় উপ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ‘হাওর এলাকার জনগণের জীবন মান উন্নয়ন জীব ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইমামদের উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে প্রকাশনা বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব। পরে তাকে আবার হালাল সনদ বিভাগ ও ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তাকে চারটি বিভাগের পরিচালক পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ায় অনেকেই বিস্মিত।
মুহাম্মাদ রফিক উল ইসলাম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (প্রশাসন ও কার্যক্রম) মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের উপ-পরিচালক থাকা অবস্থায় ল অ্যান্ড এস্টেট বিভাগের চলতি দায়িত্ব পেয়েছেন। সেইসঙ্গে তিনি প্রতিটি জেলা, উপজেলায় একটি করে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
সার্বিক বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মহা. বশিরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিদেশে অবস্থান করায় কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।