জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত এবারের সামার স্পেশাল অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে ৭৯ জন খেলোয়াড় অংশ নেন। তাদের মধ্যে মৌলভীবাজারের চার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে খেলোয়াড় স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। লিখেছেন ওমর ফারুক নাঈম, মৌলভীবাজার -
জন্মগত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় সমাজ আর স্বজনদের অনাদর অবহেলার শিকার হয়েছিলেন ওরা। অদম্য ইচ্ছা আর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ দলের স্পেশাল অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।
দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন
১৭ বছর বয়সী মহিমা খাতুন মীম, স্পেশাল নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ জায়গায় আসাটা তার জন্য এতটা সহজ ছিল না। জন্মের তিন বছর পর ওর পরিবার বুঝতে পারে ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু। সমাজ আর স্বজনদের অবহেলার শিকার হলেও মনোবল হারাননি তিনি। নিজ ইচ্ছা আর প্রচেষ্টায় এগিয়ে গেছেন তিনি। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরিবার, দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।
মীমের জন্ম মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কনকপুর ইউনিয়নের নলদাড়িয়া গ্রামে। ২০১৩ সালে বাবা তাকে মৌলভীবাজার ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুলে ভর্তি করেন।
মীমের বাবা আবদুর রউফ বলেন, আমার চার মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে প্রতিবন্ধী। তৃতীয় মেয়ে মীম দেশের হয়ে স্পেশাল অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতাতে ভূমিকা রাখায় আমাদের সব কষ্ট সুখে পরিণত হয়েছে। এখন গর্ব করে বলতে পারি, স্পেশাল অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য আমার মেয়ে।
নিজেকে দক্ষ করে তোলেন
মাহিমা আক্তার জন্ম থেকেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। জন্ম ২০০৭ সালে মৌলভীবাজার শহরের সৈয়ারপুর এলাকায়। বাবা মো. শাহজাহান মিয়া, মা সেলিনা বেগম। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় মাহিমা। মৌলভীবাজার ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুলে ২০১৯ সালে ভর্তি করা হয় তাকে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে দক্ষ করে তোলেন। অলিম্পিকে অংশ নিয়ে ২২ জুন মেয়েদের এফ ও ওয়ান ফ্রিস্টাইলে সাঁতারে স্বর্ণজয়ী হন।
মাহিমা আক্তারের মা সেলিনা বেগম বলেন, আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই অবহেলার শিকার হয়েছে। কেউ তার সঙ্গে মিশত না। সবাই অন্য চোখে দেখত। এখন ওই আমাদের গর্ব।
অনেকে ওর সাফল্যে বিস্মিত
স্পেশাল নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের গোলকিপার রিয়া রানী দাশ (১৬)। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের আটগাঁও গ্রামের মেয়ে। সপরিবারে থাকেন শহরের বাড়ইকোনায়। বাবা অজয় দাশ আর মা আবরি রানী দাশ। দুই বোনের মধ্যে সবার বড় রিয়া। ইসরায়েল স্পেশাল নারী ফুটবল দলকে ২-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
রিয়ার মা আবরি রানী দাশ বলেন, একটু বড় হলে বুঝতে পারি ও শুনতে পায় না। কথাও বলে না। আমরা খুব টেনশনে পড়ে যাই। পরে স্কুলে ভর্তি করলে খেলাধুলা ও নৃত্য শেখে। যারা ওকে অবহেলার চোখে দেখত, আজ অনেকে ওর সাফল্যে বিস্মিত।
সবার কাছে ছিল অবহেলার পাত্র
জন্মগতভাবেই প্রতিবন্ধকতার শিকার তানিয়া আক্তার সুমাইয়া ও ওর ছোট ভাই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে শিক্ষকরা তাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কারণ ও কথা বলতে, শুনতে পারে না। সবার কাছে ছিল অবহেলার পাত্র। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের সালামিটিলা গ্রামে ওর বাড়ি। বাবা সজ্জাদ মিয়া, মা সুফিয়া বেগম। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সুমাইয়া।
ওর মা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের এই বিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে ওকে ভর্তি করান। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে ও নিজেকে দক্ষ করে তোলে। ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন ১৫ বছরের তানিয়া আক্তার সুমাইয়া।
প্রধান শিক্ষক মল্লিকা রানী গোস্বামী যা বললেন
মৌলভীবাজার ব্লুমিং রোজেস বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক মল্লিকা রানী গোস্বামী বলেন, আমাদের স্কুলে ১৩০ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। আমার প্রতিষ্ঠানের চার শিশু মৌলভীবাজার জেলার মুখ উজ্জ্বল করেছে। ঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিচর্যা পেলে প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমাজের বোঝা না হয়ে অহংকার হতে পারে তার প্রমাণ মাহিমা, সুমাইয়া, রিয়া ও মীম।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যা বললেন
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, আমাদের জেলার চার প্রতিবন্ধী শিশু দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। জেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে ওদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। অবহেলার শিকার হওয়া এ মেয়েরা এখন দেশ ও জাতীর গর্ব।
মন্তব্য করুন