‘আমার ছেলেকে যারা হত্যা করলো তারা এখনো বাইরে ঘুরে বেড়ায়, চাকরি করে! তাদের তো ধরে না। এখনো বিচারও হইলো না, বিচার আর কোন দিন হইবে?’ আক্ষেপ করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম। দুচোখ বেয়ে ঝরা অশ্রুধারা ছাপিয়ে এ সময় তার চোখে-মুখে ছেলে হারানোর শোকের পাশাপাশি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে দীর্ঘ এক বছরেও আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার না হওয়ার ক্ষোভ ও আক্ষেপের চিহ্ন। ছেলে হত্যার বিচারের অপেক্ষায় থাকা শোকে মুহ্যমান এই মা ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে শুধুই প্রশ্ন করেন—‘আমার ছেলের দোষটা কী ছিল?’ এ চিত্র গত রোববার দুপুরে রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুরে আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ির। এমন প্রেক্ষাপটের মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে আজ মঙ্গলবার।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন পার্ক মোড় এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। যে ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরির পাশাপাশি আন্দোলনের পালে লাগে জোর হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন ওই আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় মুখ। বিক্ষোভরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে অসময়ে নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। সেদিন থেকে শুরু হয় আবু সাঈদের পরিবারের শোকযাত্রা, আর বিচারের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা।
ছেলে হারানোর পর থেকেই ছেলের কবরের পাশে বসে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে মনোয়ারা বেগমের। দরজার পাশে বসে থাকেন একাকী, চোখে সর্বক্ষণ জলের রেখা।
বিলাপ করতে করতে মনোয়ারা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ছেলের কি দোষ আছিল! সে তো কোন দোষ করে নাই। কিন্তু গুলি করি হামার ব্যাটাক মারি ফেলাইছে। এক বছর হয়া গেইলেও এখনো বিচার হইলো না! হামার কোনো চাওয়া নাই, যারা খুন করছে তাদের যেন শাস্তি হয়।’—এ কথাগুলো বলেই কান্নার ভারে ফের থেমে যান মনোয়ারা বেগম।
শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম কথা বলার সময় পাশে বসা বাবা মকবুল হোসেন কথা বলছিলেন একবুক গর্ব ও কষ্টের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘দুনিয়ার সব মানুষ আছে; কিন্তু আমার ছেলে নাই—এ দিক দিয়ে খুব দুঃখ পাই। কিন্তু আমার ছেলের উছিলায় অনেক আলেম-ওলামা জেল থেকে ছাড়া পাইছে—এইটা ভাবলে গর্ব হয়।’
আবু সাঈদের বাবার চোখে একরাশ শোক থাকলেও সন্তানের আত্মত্যাগ যে বড় কিছু পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তাতে যেন এক ধরনের তৃপ্তিও খুঁজে পান তিনি। মকবুল হোসেন বলেন, ‘সরকার সুনজর দিয়ে অপরাধীর যেন বিচার করে। আমি চাই সরকার কঠিনভাবে বিচার করুক। আমার ছেলের সঙ্গে আরও হাজার হাজার মানুষ শহীদ হইছে, অনেক বাপ-মার বুক খালি হইছে। আমি চাই, এমনটা যেন আর কোনো মায়ের সঙ্গে না হয়। যা হইছে আমার, তা যেন আর কারও না হয়।’
এদিকে গতকাল সোমবার আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে এ মামলার ৩০ আসামির মধ্যে পলাতক ২৬ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তাদের মধ্যে আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ। গতকাল সকালে ট্রাইব্যুনাল-২-এ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে ৩০ জনকে আসামি করা হয়। যাদের মধ্যে মাত্র চারজন গ্রেপ্তার আছেন। তারা হলেন- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।
এর আগে গত ২৬ জুন আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়।
তবে এর মধ্যেই এ প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা এ হত্যা মামলার প্রতিবেদন দাখিলের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গণশুনানির দাবিতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
সংবাদ সম্মেলন করে তারা জানিয়েছেন, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে ২৩ জুন রংপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি গণশুনানি আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সন্দেহ ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
আবু সাঈদ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে তারা এ ঘটনার সঙ্গে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন। তবে এবারও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তারা পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তারা একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করলেও পুরো বক্তব্যে পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেননি। অথচ জাতিসংঘের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকাণ্ড।’
শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, ‘দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। প্রথমত, একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকাণ্ডকে সচেতনভাবে ‘প্রশাসনিক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যেসব ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এ ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের তদন্ত থেকে সূক্ষ্মভাবে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর আস্থা আছে বলে জানিয়েছেন শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ দাখিল পিছিয়ে গেছে—এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমার একটা বিশ্বাস আছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) থেকে যেটা প্রতিবেদন আসবে, সেটা সঠিক ও সত্যনিষ্ঠ হবে।’
তার পরিবার ন্যায়বিচার চায় উল্লেখ করে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আবু হোসেন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনটা কতটা যুক্তিসংগত, আমি জানি না। আবু সাঈদের যারা সহযোদ্ধা ছিলেন, যারা এখনো আন্দোলনে আছেন, তাদের সঙ্গে বসে, তাদের কথা শুনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা উচিত। আমরা চাই ন্যায়বিচার—না কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি ফাঁসুক, না কোনো প্রকৃত অপরাধী ছাড় পেয়ে যাক।’
মন্তব্য করুন