বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গত বছরের জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় অভিযোগ গঠনের পর আনুষ্ঠানিক বিচারও শুরু হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজন। অভিযোগ গঠনের শুনানি পর্যায়ে রয়েছে দুটি মামলা। বিচারপূর্ব (প্রি-ট্রায়ালের) পর্যায়ে থাকা মামলার সংখ্যা ৩০। তার মধ্যে ১০টি মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলায় ২০৯ আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮৪ জন।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এসব তথ্য নিশ্চিত করে জানান, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় ৫ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তদন্ত সংস্থার ২২ তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রসিকিউশন টিমে চিফ প্রসিকিউটরসহ ১৭ জন প্রসিকিউটর কাজ করছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়ের (সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি) এ মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জমা দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র, ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন।
গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৬ জুন এ মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারির পরও হাজির না হওয়ায় অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১০ জুলাই এ মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
এদিকে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে গত ১৪ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সেইসঙ্গে এ মামলার সূচনা বক্তব্যের জন্য আগামী ১০ আগস্ট এবং সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১১ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এ ছাড়া আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি চলমান রয়েছে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ মামলায় অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি গ্রহণ করছেন। এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগে থাকা ৩০ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার রয়েছেন ছয়জন।
পলাতক ২৪ আসামির জন্য রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি আগামী ৭ আগস্ট। প্রসিকিউশনের আবেদনের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই দিন ধার্য করেন। এ মামলার ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্র্যাইব্যুনাল-২। এই ১৬ আসামির মধ্যে আট আসামি গ্রেপ্তার আছেন।
ডিসেম্বরের মধ্যে টপ কমান্ডারদের বিচার
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের যেভাবে বিচার প্রক্রিয়া এগোচ্ছে তাতে টপ কমান্ডারদের বিচার, একটা বড় অংশের বিচার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সমাপ্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘জুলাই গণহত্যার বিচার, আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন’ অনুষ্ঠানে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) দায়ের করা হয়। ট্রাইব্যুনালে প্রাপ্ত অভিযোগ ও অভিযুক্তের সংখ্যা, দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গত ৮ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে সরকার। এই ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং মাদারীপুরের জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
এদিকে ট্রাইব্যুনাল-২ গঠনের পর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মন্তব্য করুন