‘জীবনে যদি দ্বীপ জ্বালাতে নাহি পারো সমাধি পরে মোর জ্বেলে দিও...’ গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের সেই চরণ সত্যি করে মৃত্যুর প্রায় তিন বছর পর দেশীয় চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান নির্মাতা আজিজুর রহমান মরণোত্তর একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। সিনেমায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাকে এ পদক দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, অঙ্কনশিল্পী, প্রযোজক, কাহিনিকার, পোস্টার মেকার, সেট ডিজাইনার, টাইটেল মেকার, মেকআপ আর্টিস্ট এত বহুগুণী মানুষ হয়েও জীবদ্দশায় কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ‘ছুটির ঘণ্টা’খ্যাত এ নির্মাতা। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল তার পরিবারের সদস্যদের। অবশেষে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে এ স্বীকৃতি আসায় পরিবারের আক্ষেপ ছাড়িয়ে গেছে গর্ব ও প্রাপ্তির আনন্দে।
এ প্রসঙ্গে আজিজুর রহমানের স্ত্রী শামিম রহমান বলেন, ‘খুব আনন্দিত আমরা। কিন্তু উনি বেঁচে থাকলে আরও আনন্দিত হতেন। আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই তাকে পুরস্কৃত করার জন্য। উনি কোনো দল করতেন না, চাটুকারিতা করতে পারতেন না এজন্য অনেক ভালো ভালো ছবি করেও কোনো জাতীয় পুরস্কার পাননি। এটা আমার ছেলেমেয়েদের আক্ষেপ ছিল। আল্লাহ আমাদের সে আক্ষেপ মিটিয়েছেন। তবে উনি সবসময় বলতেন, ‘আমি পুরস্কার না পাই, দর্শকদের ভালোবাসা তো পেয়েছি।‘ আলমগীর ভাই, উজ্জ্বল, রোজিনা, সুচরিতা, শাবানাসহ সে আমলের যারা ছিলেন তারা অনেকেই ফোন করেছেন। সবার একই কথা, আজিজ ভাই নাই, উনি দেখে যেতে পারলেন না!’
মেয়ে আলিয়া রহমান বিন্দি বলেন, ‘বাবা প্রায় দেশের চলচ্চিত্রের জন্মলগ্ন থেকেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত। আক্ষেপ ছিল যে এ দেশের প্রেক্ষাপটে এত বক্তব্যধর্মী সামাজিক ছবি বানিয়েও কোনো জাতীয় পুরস্কার পাননি। উনার মৃত্যুর পর হলেও সেই আক্ষেপের অবসান হয়েছে। এজন্য চলচ্চিত্রের মানুষদের এবং সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। যদিও মরণোত্তর পুরস্কারটা আসলে খুব একটা সুখকর নয়। আমি মনে করি মূল্যায়নটা মানুষের জীবদ্দশায় করা উচিত।’
মানুষের মাঝে আজিজুর রহমানকে বাঁচিয়ে রাখা প্রসঙ্গে বিন্দি বলেন, “আমরা চাই ছুটির ঘণ্টা বা অশিক্ষিতের মতো চলচ্চিত্রের কথা পাঠ্যপুস্তকে আসুক। ছুটির ঘণ্টার পর অনেক অভিভাবক সন্তান ঘরে না ফিরলে স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। চলচ্চিত্র সমাজের কথা বললেও এ সচেতনতামূলক বিষয়গুলো শুধু চলচ্চিত্রে না থেকে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া বাবা মারা যাওয়ার আগে চিরকুটে লিখে গেছেন পরিচালক সমিতিতে কিছু টাকা দিতে এবং ‘আজিজুর রহমান ফাউন্ডেশন’ করে কৃতি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিতে, সেটা আমরা করছি।”
আজিজুর রহমান ১৯৩৯ সালের ১০ অক্টোবর বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় আহসানুল্লাহ ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি ও ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চারুকলা আর্ট ইনস্টিটিউটে কমার্শিয়াল আর্টে ডিপ্লোমা করেন। ১৯৫৮ সালে ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে এহতেশামের সহকারী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। তার নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল’ মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। তিনি মোট ৫৩টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’ নির্মাণ করে খ্যাতি পেয়েছেন। লম্বা ছুটি ঘোষণার পর একটি স্কুলের টয়লেটে এক ছাত্রের আটকে পড়ে মৃত্যুর সেই চলচ্চিত্রায়ন কাঁদিয়েছিল বহু মানুষকে। আর ‘অশিক্ষিত’ চলচ্চিত্রে বয়স্কদের শিক্ষাগ্রহণে কোনো বয়স নেই সেটা দেখানো হয়েছে এবং শিক্ষাকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ‘মাটির ঘর’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘অতিথি’, ‘রঙ্গিন রূপবান’, ‘দিল’ সিনেমাগুলোও পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘মাটির ঘর’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’ দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়। ২০২২ সালের ১৪ মার্চ কানাডার টরন্টোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আজিজুর রহমান।