দেশের সর্বোচ্চ পথশিশু রয়েছে ময়মনিসংহে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে পথশিশু জরিপ ২০২২ এ তথ্য উঠে আসে। জেলায় ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী পথশিশুর হার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ও মঙ্গলবার (০১ অক্টোবর) ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন, গাঙ্গিনারপাড়, জয়নুল আবেদিন উদ্যানে দেখা গেছে এসব পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিতদের। তাদের মধ্যে অনেক শিশু ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করে তিনবেলা খাবার পায়।
পথশিশুদের সঙ্গে কথা হয় কালবেলা প্রতিবেদকের। তারা জানায়, কারও বাবা মারা গেছে, মা অন্যত্র চলে গেছে। কারও বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে। কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমানে বাড়ি ছেড়েছে। কেউ আবার বাবা-মায়ের কথা বলতেও পারে না।
সোমবার রাতে ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশনে গিয়ে পাওয়া যায় কয়েকজন শিশুকে। তারা প্ল্যাটফর্ম এলাকায় পানি ও পপকর্ন বিক্রি করছে। রাতে প্ল্যাটফর্মে ঘুমায়। একজন ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করার পর তাদের তিনবেলা খাবার এবং হাত খরচ দেয়।
সৎমায়ের অত্যাচারে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা ১৪ বছর বয়সী মোমেন মিয়া জানায়, তার মা মারা যাওয়ার পরই কপাল পুড়েছে। প্রায় এক বছর থেকে এ স্টেশনেই তার ঠিকানা।
শিশু জুনাঈদ, শাওন মিয়া ও নয়ন মিয়া পানির বোতল বিক্রি করে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তাদের কারও বাবা নেই, কারও মা নেই, নয়নের বাবা-মা কেউ নেই। তারা তিনজনই ব্যবসায়ী শামছুল হকের অধীনে পানি ও পপকর্ন বিক্রি করে। শামছুল জেলার ত্রিশাল উপজেলার আউলিয়া নগর এলাকার বাসিন্দা। শিশুদের নিয়ে স্টেশনেই ঘুমায় শামছুল।
শামছুল হক জানান, তার কাছে চারজন শিশু আছে। তাদের দিয়ে পানি বিক্রি ও হোটেলে পানি সরবরাহ করে তিনবেলা খাবার দিই। হাত খরচও দিই। এতে তারা অপরাধী না হয়ে কাজ শিখছে। শুধু তিনি নয়, এ স্টেশনে আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী রয়েছে, যাদের দিয়ে ব্যবসা চলে। স্টেশনটিতে অন্তত ২০ জন পথশিশু রাতযাপন করে যোগ করেন শামছুল।
বেসরকারি সংস্থা কারিতাস ‘আলোকিত শিশু প্রকল্প’ নামে পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে নগরের ৮, ৯, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত সুবিধার আওতায় আসা একক শিশু ৯০, মা-বাবাসহ রাস্তায় থাকে এমন শিশু ১৫১, পরিবারের সঙ্গে বস্তিতে বা ঝুপড়িতে বসবাস করে; কিন্তু অধিকাংশ সময় রাস্তায় থাকে এমন শিশু ২৪৩ এবং অন্যের আশ্রয়ে থাকে এমন ৩২ জন শিশু। এর মধ্যে ১২ শিশুকে পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটিতে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুদের পৃথক স্থানে রাতযাপনের ব্যবস্থাও রয়েছে। তিনবেলা খাবার, মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিনোদন, খেলাধুলার ব্যবস্থা করে।
আলোকিত শিশু প্রকল্পের ফিল্ড অফিসার বিপাশা মানখিন বলেন, একটি পরিবারের মধ্যে থাকলে শিশুরা যে সুযোগ-সুবিধা পেত আমরাও সেসব দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক শিশু বাবা-মায়ের নাম বলতে পারে না, যারা বলতে পারে তাদের বাবা-মায়ের পরিচয়পত্র না থাকায় শিশুদের জন্মনিবন্ধন করা যায় না। এ জন্য বিড়ন্বনায় পড়তে হয়। দরিদ্রতা, বাবা-মায়ের অসচেতনতা, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা অথবা মা মারা যাওয়া। এ ছাড়া কওমি মাদ্রাসার কঠোর শাসনের কারণে পালিয়ে আসে শিশুরা।
নগরের এস কে হাসপাতালের পেছনের এলাকায় শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা ও অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ‘আমরা সবাই রাজা’ নামে একটি ক্লাব পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি ও ছবি আঁকা শেখানো হয়।
ময়মনসিংহে কী পরিমাণ পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি দপ্তরগুলোতে। ময়মনসিংহ জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপপরিচালক সৌরভ পাল মিঠুন বলেন, তবে পথশিশু জরিপ ২০২২ অনুযায়ী ৫-১৭ বছর বয়সী পথশিশুর হার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে সংখ্যা সংরক্ষণে নেই।
সমাজসেবা অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক রাজু আহমেদ বলেন, কী পরিমাণ পথশিশু রয়েছে সে পরিসংখ্যান আমাদের কছে নেই। যখন কোনো শিশু আইনের সংস্পর্শে আসে বা পুলিশ কর্তৃক আনা হয় তখন তাকে আমরা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করি। শিশুদের আমরা নিজেরা ধরে আনি না।
মন্তব্য করুন