সিলেটে পর্যটনকেন্দ্রে যেতে পর্যটকদের বাধা দিয়েছেন এলাকাবাসী। রোববার কোম্পানীগঞ্জের উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্র থেকে সরে যাওয়ার জন্য প্রথমে অনুরোধ করলেও পরে হুমকি দেন তারা। তবে, এলাকাবাসীর নামে এরা কে বা কারা এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি প্রশাসন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রোববার (৮ জুন) বিকেলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের চরারবাজার এলাকার উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের বাধা দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
জানা যায়, ঈদের পর দিন সিলেটের বিভিন্ন এলাকার পর্যটকরা ভ্রমণে গিয়ে আনন্দ করছিলেন উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্রে। এ সময় স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গিয়ে তাদের বাধা দেন। পরে তাদের স্পট থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলপ্রয়োগ করেন।
ভাইরাল ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, এই এলাকার আলেম-ওলামা ও স্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎমাছড়াকে পর্যটন কেন্দ্র করা যাবে না। তাই আপনারা যারা এখানে এসেছেন দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আপনারা এখানের পরিবেশ নষ্ট করবেন না। আপনাদের মতো অনেকেই এখানে এসে মদ্যপান করে অশ্লীল কার্যকলাপ করে, যার ফলে আমাদের এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এই এলাকার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য আমরা এখানে পর্যটকদের আসতে নিরুৎসাহিত করছি। আজকের পর আপনারা এখানে আর কোনো দিন আসবেন না।
ভিডিওতে আরও বলতে শোনা যায়, ঈদের আগের দিন উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের ওলামায়ে কেরাম, মুরুব্বি ও যুবসমাজ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে উৎমাছড়া এলাকায় পর্যটনের নামে কেউ আসতে পারবে না।
সিলেটের ব্যবসায়ী ওয়াজিহ আহমেদ বলেন, আমি যেভাবে আমার স্ত্রীকে নিয়ে উৎমাছড়ায় গিয়েছি অন্য পর্যটকরাও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সেখানে যান। এই জায়গায় কেউ কোনো অশ্লীলতা করেছে এমন দেখিনি। তাই এই পর্যটন স্পটের সুন্দর পরিবেশে কারও অশ্লীলতা করতে মন চাইবে না। কিন্তু হঠাৎ স্থানীয় প্রায় ৭০ জনের মতো হুজুর এসে বলে এখান থেকে চলে যেতে। এটা নাকি পর্যটন স্পট না। তখন আমরা যারা ছিলাম সবাই চলে আসি। কারণ সেখানে আমরা ঘুরতে গিয়েছি কারও সঙ্গে তর্ক করতে যাইনি। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ভিডিওতে যুব জমিয়ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শাখার সহসভাপতি মুফতি রুহুল আমিন সিরাজীকে বলতে শোনা যায়, আপনাদের আমরা সম্মানের সাথে অনুরোধ করে বলছি আগামীতে কোনো দিন আপনার এখানে আসবেন না এবং আপনাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে জানিয়ে দেবেন উৎমাছড়াকে পর্যটন হিসেবে বন্ধ করে দিয়েছে এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে জানতে জমিয়ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শাখার সহসভাপতি মুফতি রুহুল আমিন সিরাজী কালবেলাকে বলেন, পর্যটনের নামে কিছু মানুষ এখানে এসে অশ্লীল কার্যক্রম করে, এ কারণে আমাদের এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যুবসমাজ এসব কার্যক্রম দেখে বিপথগামী হচ্ছে।
এসব বিষয় বিবেচনা করে স্থানীয় আলেম-ওলামা, মুরুব্বি ও যুবকদের নিয়ে ঈদের আগের দিন বসে মিটিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়েছে এই প্রজনন স্পটটিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ কারণেই আমরা রোববার বিকেলে পর্যটকদের সম্মানের সাথে বুঝিয়ে বলেছি উৎমছড়ায় আর না আসতে।
এ বিষয়ে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি উতমা ছড়ায় যেভাবে পর্যটকদের যেভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে তা দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়েছি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া অন্য কোনো এলাকায় কেউ মানুষকে প্রবেশে এভাবে বাধা দিতে পারে না। এটি স্পষ্ট তো আইনের লঙ্ঘন। পর্যটনের কারণে অনেক মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। এটি অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যারা এভাবে বাধা দিয়েছেন তারা আসলে কি উদ্দেশে বাধা দিয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কারণ ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি, কিছু মানুষ পর্যটকদের নানাভাবে সরিয়ে সুযোগ নিয়ে ওই এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করেছে, প্রকৃতি বিনষ্ট করেছে। তাই এর পেছনে হীন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার। আমরা শুনেছি ইতোমধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। আমরা চাই এই তদন্ত কমিটি সঠিকভাবে তদন্ত করুক, সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করুক। এই ধরনের অপকর্ম রোধে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম কালবেলাকে বলেন, সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনাকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। পর্যটন করপোরেশন থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন সিলেটে পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা বললেও পর্যটকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনায় তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
তিনি আরও বলেন, পর্যটনশিল্প কোনো এলাকার জন্যেই ক্ষতিকর নয়, বরং সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যাপক কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে সহায়ক। কিন্তু এখানে পর্যটকদের বিদায় করতে এলাকাবাসীর ব্যানারে যারা গিয়েছে তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করছি। কারণ এলাকাটি পাথর সমৃদ্ধ হওয়ায় স্থানীয় পাথরখেকো চক্র আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কারণ পর্যটকদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে অবৈধভাবে পাথর চুরি করে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যাবে না বিধায় এদের পরামর্শেই এমন কাণ্ড ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলেই মনে করছি। কারণ এর পূর্বে ভোলাগঞ্জের পরিবেশ বিপর্যয়ে উক্ত এলাকার পাথরখেকো গোষ্ঠীর তৎপরতাও এমনই ছিল।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার কালবেলাকে বলেন, উৎমাছড়ার ঘটনা নিয়ে আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং এমন ঘটনা আর হবে না বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা পর্যটকদের অনুরোধ করেছেন তারা যেন স্পটে শালীনতা বজায় রাখেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ কালবেলাকে বলেন, উৎমাছড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে আমরা দেখছি। এ রকম ঘটনা এর আগে এ অঞ্চলে ঘটেনি। কারা করেছে কী উদ্দেশে করেছে তার জন্য তদন্ত করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে কী ঘটনা ঘটেছে।
পর্যটকদের বাধা দেওয়া প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের কেউ কাউকে নিষেধ করতে পারেন না ও তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
মন্তব্য করুন